আমি অন্ধবিশ্বাস ছাড়া কি নিয়ে বাঁচব বলতে পারেন? আমার দণ্ডি কাটা দেখে, আমার পুজোর এত উপাচার দেখে হাসছেন। ভাবছেন আমি কুসংস্কারাচ্ছন্ন। হাসুন। কিন্তু আমায় বলতে পারেন আর কি আছে আমার বাঁচার? সংসার করি। ছেলেটা স্কুলে যায়, ও অফিসে যায়। না ফেরা অবধি প্রাণ ধুকধুক করে। কে জানে রাস্তায় কি হল! ছ'মাস অন্তর চেক আপ করাই, হোল বডি। পয়সা যায় যাক, মানুষটা তো থাকুক।
দেখুন আমার সবেতে ভরসা। অ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি, কবিরাজী, টোটকা, মাদুলি, ধুলোপড়া, বাণ মারা… কালী-দুর্গা, আল্লাহ্, গড্, বুদ্ধ, নানক --- সব সব সব, যা যা আরো মনে পড়ল না সবেতেই বিশ্বাস আমার। এমনকি নাস্তিকদের কথাতেও আমার বিশ্বাস। আমার একটাই চাহিদা, আমার পরিবারটা যেন ভেসে না যায়। শান্তিতে থাকে। তার জন্য আমি যা করতে হয় করব।
ও? ও জানি না মানে কিনা। কিন্তু বাধা দেয় না। আসলে কি জানেন তো পুরুষ মানুষ তো, চট করে অত নীচু হতে পারে না। ইয়েতে লাগে। কিন্তু আমি যে করি তাতে বাধা দেয় না। বাইরে রাগ দেখায় বটে। কিন্তু ওটুকু না দেখালে ওরই বা পুরুষ পুরুষ ভাবটা থাকে কি করে বলুন? কিন্তু আমি উপোস করলে সব এনে দেয়। অম্বল হলে, গ্যাস হলে গালাগাল করে যদিও। কিন্তু জানে, এতে ওদের পরিবারেরই মঙ্গল। কেন, ওর মা-জেঠিমা করেনি? কি ক্ষতি হয়েছে বলুক দেখি? মনে মনে একটা ভয় নেই? সবার আছে। কেউ দেখায়, কেউ দেখায় না। আজকাল কত পুরুষকেও দেখবেন দণ্ডি কাটছে। পুরুষ মানুষ যে কতটা গলা জলে পড়লে দণ্ডি কাটে, পুজোর ডালা নিয়ে দাঁড়ায় আপনাকে কি বলব। কিন্তু উপোস? সেও করে না যে তা নয়। করে, তবে আমাদের মত এত না। ওদের ভগবান বানায়নি ওভাবে। ওরা পারে না।
দেখুন ছেলেদের অনেক ঢং আছে। খেলাটা, রাজনীতিটা, এটাসেটা নিয়ে ঢং করার অনেক কিছু আছে। আমাদের দুটো কথা বললেই আসল কথাটা পেটের বাইরে চলে আসে। কিন্তু ওদের দেখুন, বানিয়ে বানিয়ে এমন কথা বলে যায় বাইরের লোকের সামনে যে আমি ভাবি, বাব্বা! এতোও! আমরা কথা বলতে গেলে তাই তো ভয় পাই, যদি আসল কথাগুলো বলে ফেলি! আমাদের নিয়ে সকলের ভয়। আমাদের নাকি ঢং! শুনে আমার যা হাসি পায়? ওরে আমরা তো ঢং করি। আর তোরা তো নিজেরাই আপাদমস্তক এক-একটা ঢং! কোনটা যে আসল আর কোনটা যে নকল, কে বুঝবে? এক-এক সময় মনে হয় ওরা নিজেরাই আদৌ বোঝে?
আমাদের এটা-ওটা সেজে থাকলে চলে বলুন? আমরা যা, আমরা তাই। কুসংস্কার ছাড়া আমাদের মধ্যে কতজন বেঁচে আছে বলুন? হাতে গোনা। তাও যারা আছে তারা কুসংস্কার ছাড়া যে আছে সেটা বোঝাতেই কানের মাথা খেয়ে রেখে দেয়। যেন কি একটা হয়েছে কিছুই মানে না বলে। আরে মানবি না মানবি না, অত রোয়াব দেখানোর কি আছে বাপু! আমরা কি দেখাতে যাই উপোস করেছি বলে, কি উপোস করতে গিয়ে পিত্তিবমি উঠে এসেছে বলে? আমরা চুপ করেই থাকি।
আসলে যাই বলুন, আমাদের জন্য আর কিছু নেই। টিভি-সিরিয়ালই বলুন, এর-ওর রান্নাঘরই বলুন, কি দিদি-জেঠি নাম্বার ওয়ান কি টু-ই বলুন --- টিভি বন্ধ হল, আর আমাদের ওসব ভাবনাগুলোও বন্ধ হল। আবার সেই বাজার-দোকান, হেঁশেল, আর যাদের যাদের বাইরের কাজ তাদের বাইরের কাজ। আমরা সাধারণেরা এর বাইরে কি চিনি বলুন? নিত্য নতুন ভগবানের আবির্ভাব কাদের জন্য হচ্ছে? এই আমরা আছি বলেই না? যত যত ঈশ্বরের থান দেখবেন, সে বাবাজী হোক, কি বড়মা, মেজমা, সেজোমা। আমরাই তো আছি। পুরুষেরা আমাদের এগিয়ে দিয়ে নিজেরা বুদ্ধিজীবী সেজে বাতেলা মারছে। আমরা শুধু নাকি একই থেকে গেলাম, আমরাই নাকি পিছোচ্ছি, আর ওনারা নাকি এগিয়ে এগিয়ে সেই আমেরিকার ওই খাঁড়া হাতে মানুষটার মুকুটে গিয়ে চড়েছেন! আমরা হলাম সেকেলে, আর তেনারা হলেন একেলে! আসলে কি জানেন? আমাদের শিকড় বানিয়ে নিজেরা মাচা করে আধুনিক হবেন। আর আমরা যত তিরস্কার, গঞ্জনা, নিন্দে, ব্যঙ্গ সহ্য করে যাব। আমরা যতই বকি ওদের কাছে অবলা। কেন বলুন তো? ওদের মত অত গুছিয়ে যুক্তি দিয়ে মিথ্যা বলতে পারি না কিনা!
দেখুন, গোটা সমাজই তাই চায়। আমরা চাকা হই। তেনারা রথী হবেন। দেখেন না মন্দিরের সব পুরুতগুলোর গলায় পৈতে। তাও ক'টা মেয়েমানুষ পুজো কচ্চে বলে এমন করে কাগজে খবর ছাপছে যেন রাজস্থানে ক্যাঙারু দেখা দিয়েছে। আমাদের ব্যতিক্রমী, সাহসী এইসব তকমা লাগিয়ে আমাদেরকে কি দিয়েছে বলুন তো শেষমেশ? সিঁদুর মাখানো কাঁচকলা!
আমার ঘেন্না ধরে যায় এসব বলতে বলতে। তবু ঘরের কথা আর বাইরের কথায় এত অমিল দেখে মাঝে মাঝে গলা খাঁকারি দিতেই হয়। কুসংস্কার ছাড়ো? আগে তোরা নিজেরা ছাড়। ঢংগুলো ছাড়। ভণ্ডামিগুলো ছাড়। তারপর আমরা দেখছি আমাদের কুসংস্কারগুলো ছাড়া যায় কিনা। সমাজ জুড়ে আমাদের জন্য আজ অবধি চরকির পর চরকি কেটে ঘুরাচ্ছিস। একটা দাগ মুছতে গেলে দশটা দাগের ফিকির খুঁজিস। তোদের বুলি আছে, আমাদের কুসংস্কার আছে। এই নিয়ে বাইরে ভিতরে চলছে লড়াই। আমরাও জানি দুটোই মিথ্যা। যেদিন আমরা এই মিথ্যাবোধটাকে মিথ্যা বলেই জেনে যাব সেদিন তোরা তোদের বক্তিমের ঝুড়ি নিয়ে কোথায় বেচতে যাবি দেখব। তোরা ভালো করে জানিস আমরা তা করতে পারব না। সেটা আমাদের ধাতে নেই। তাই কুসংস্কার বলে যা আমাদের আছে তা-ই নিয়ে আমাদের থাকতে দে। যেদিন মনে হবে দূরে ফেলে দেওয়ার ফেলে দেব। আর একটা কথা, কথায় কথায় বিদ্যাসাগর আর রামমোহন দেখাস না। ও জিনিস যুগে যুগে একটা কি দুটো হয়। তোরা তা নোস। অকারণে নিজেদের সঙ্গে ওদের গুলাস না। যদি তা-ই হতিস তবে আজ কুসংস্কারের দোহাই পাড়তে হত না। সমাজটা অন্যরকম হত। কিরকম? যেমন হবে ভাবলে তোদের রাতের ঘুম ছুটে যায়! সে নিয়ে আর কোনো কথা না বলাই ভালো। এইখানেই থামি আজ। আমাদের উদ্ধারের জন্য আর নতুন করে কিছু ভাবতে হবে না, না তোদের, না তোদের ধামাধরা কিছু শাড়িপরা বুদ্ধিজীবীদের। আমাদের গোদা বুদ্ধিতেই আমরা জানি কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল। আমাদের শুধু হাঁটার জায়গা করে দে। বাঁচার আকাশটা ছেড়ে দে। বুকের পাটা থাকে করে দেখা। মন থেকে। ঢং করে নয়। বাকিটা আমরা বুঝে নেব।