সৌরভ ভট্টাচার্য
20 July 2020
মা,
আজ শ্রাবণ মাসের প্রথম সোমবার। খুব বৃষ্টি। বাগবাজারের রাস্তাঘাটও নিশ্চয় বৃষ্টিতে ভিজছে। শ্রাবণের বৃষ্টি। তুমি বৃষ্টিতে কি করতে? কেউ লেখেনি কেন? তোমার নরেন বৃষ্টি দেখতে ভীষণ ভালোবাসত, বইতেই পড়েছি। নিবেদিতাকে, মানে তোমার খুকীকে সে নাকি একবার বলেছিল, বৃষ্টির সময় ওই যে বড় বড় বুদবুদগুলো মেঠো রাস্তা দিয়ে শ্রাবণধারার সাথে ভেসে ভেসে চলে যায়, সে দেখবে। তোমাকে নিয়ে এমন কোনো কথা আমি পড়িনি, শুনিওনি কারোর কাছে। আমি জানি না তোমার জয়রামবাটির বৃষ্টি ভালো লাগত, না বাগবাজারের, নাকি দক্ষিণেশ্বরের। জানি না। কেউ লেখেনি কেন?
দক্ষিণেশ্বরের ওই ঘরে যখন তুমি, যখন শ্রাবণমাস এমন রাজার মত সেজে এসেছে, কিম্বা মেঘদূত তোমার ঘরের ছাদের উপরে মহাকাশ ছাপিয়ে... কি করতে তুমি? হয় তো কান পেতে আছ, ওই ঘরের দিকে যেখানে হয় তো কীর্তন চলছে তখন। কে গাইছে? নরেন? নাকি তোমার সে? তুমি কান পেতে আছ। হয় তো বৃষ্টির প্রবল আওয়াজে শুনতে পাচ্ছ না। তবু যেন পাচ্ছ শুনতে। শোনে তো কান না মা, প্রাণ। পাশেই গঙ্গা। বৃষ্টির জলে ঝাপসা। হয় তো তুমি ভোরবেলায় দাঁড়িয়ে আছ। অনেক ভোর। প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে। তুমি তাও দাঁড়িয়ে ভিজছ। তুমি যেন সমাধিস্থ। আত্মমগ্ন। দূরে মন্দিরের নহবতে তখন হয় তো মিঞা মল্লার বাজছে। তোমার পাশটিতে কখন এসে তোমার সে দাঁড়িয়েছে তুমি টের পাওনি। পাবে কি করে? তুমি তো রামকৃষ্ণগতপ্রাণা, তোমার আবার ঠাকুরের কাছে থাকা আর দূরে থাকা। তোমার চোখদুটো বন্ধ। হাতদুটো বুকের কাছে জড়ো করা। তুমি ধ্যানমগ্না। শ্রাবণের না হয় সেদিনও হোক প্রথম সোমবার। তোমার বুকের মধ্যে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে বিশ্বসংসারের করুণতম যে সুর, সেটি। তোমার দুই ধ্যানবন্ধ পদ্মকোরকের মত দুটো চোখের থেকে জলের ধারা নেমে আসছে। বৃষ্টির জলে মিশে তোমার গাল বেয়ে পড়ছে মাটিতে। তারপর বৃষ্টির সেই বড় বড় বুদবুদের সাথে মিশে এক হয়ে গিয়ে পড়ছে গঙ্গায়। কেউ জানতে পারছে না, গঙ্গায় মিশছে কিসের ধারা। জানেন শুধু ঠাকুর। তিনি স্থির দৃষ্টিতে আকাশ-পৃথিবীর সঙ্গম দেখছেন, শ্রাবণধারায়। অনাদিকালের করুণাধারা আজ যেন শরীর ধারণ করেছে তোমার মধ্যে। ঠাকুর কি গাইবেন? বিদ্যাপতি না জয়দেব? যিনি তোমার পায়ে সেদিন নিজের সমস্ত সাধনফল সমর্পণ করেছিলেন, তিনি কি একবারের জন্যেই করেছিলেন মা? হয় তো নয়। প্রতিক্ষণেই তিনি তোমার মধ্যে নিজেকে ঢেলে দিচ্ছেন। তাঁর মা তো তুমি। তাঁর মা’কে মানুষ হতে হবে। মানুষের ভাষায় কথা বলতে হবে। মানুষের কান্না বুঝতে হবে। মানুষের একাকীত্বের অন্ধকারকে প্রদীপের আলোর মত সনাথ করতে হবে।
তারপর যখন তুমি জয়রামবাটিতে। যখন সদ্য তুমি একা হয়েছ এই পার্থিব জগতের নিয়ম অনুযায়ী। সেদিনও যখন শ্রাবণ এসেছে তোমার গ্রামে, তোমায় কে চেনে তখন? কেউ না। তোমার দারিদ্র কিছু নির্মম মানুষের জন্য চরম সেদিন। তোমার শাড়িতে গিঁটের পরে গিঁট। যেখানে যেখানে ছেঁড়া সেখানেই গিঁট। অথচ ঠাকুর নাকি গিঁট দিতে পারতেন না। তুমি পারতে। তোমার যে গিঁট না দিলে চলে না। সংসারে এত ছিন্ন মানুষ, এত ছিন্ন জীবন। কে দেবে গিঁট? কে দেবে সে ছিন্ন তছনছ হয়ে যাওয়া জীবনগুলোয় স্নেহের গিঁট! যে মানুষের রিক্ততার কান্নাকে ঢেকে বলবে, আর কেউ থাক না থাক সব সময় জানবে তোমার একজন মা আছেন। তোমায় বলতে হবে তো।
তুমি শাক বুনছ তোমার কুঁড়েঘরের সামনের জমিতে। সেই বাগান ছাপিয়ে নেমেছে বৃষ্টি। তুমি একা দাওয়ায় বসে। অভিযোগহীন, অভাববোধহীন, নির্বিষাদ, গভীর তোমার চোখদুটো মেলা বৃষ্টিধোয়া রাস্তার দিকে। তুমি জানো একদিন সারাজগৎ আসবে এই রাস্তা দিয়ে তোমার কাছে। মেঠো পথে, ধুলো মেখে। তোমায় ‘মা’ বলে ডাকবে। ঠাকুর বলতেন, ফুল ফুটলে ভ্রমর আপনি আসে। তোমার হৃদয় নীড়। সে নীড়ে জন্মেছে প্রাচীনতম ডাকের তৃষ্ণা – মা। এ নীড় আশ্রয় হবে জগতের। এ তপ্ত বিশ্বের আশ্রয় হবে। আশ্রয় মানে কেবল তো স্থান না, ভালোবাসার সীমানায় শান্তিকুটির। শ্রান্ত, ক্লান্ত, উদভ্রান্ত, দিকহারা মানুষ আসবে তোমার কাছে। আশ্রয় চাইতে। শান্তিসুধা পান করতে। তোমার আঁখির স্নেহধারায় স্নাত হতে।
এরপর তুমি এলে কলকাতায় আবার। ঠাকুরের শরীর দাহ হয়ে গিয়েছে কাশীপুরে সেই কবে। তুমি আবার আসছ কলকাতায়। একবার ঘুষুড়িতে, একবার নীলাম্বরবাবুর বাগানবাড়িতে। অবশেষে বাগবাজারে। তোমার সাথে জয়রামবাটিও আসছে। তোমার সাথে আসছে বিশ্বনিখিলের মাতৃরূপ। এ রূপ আগে দেখেনি কেউ। শিশিরপাতের মত নিঃশব্দে ঝরে চলেছে। ঘাস নিজেও জানে না যেমন যে সারারাত কিসে স্নাত হল সে, ভোরে বোঝে যখন সূর্যের আলো তার উপরে মুক্তাবিন্দু তৈরি করে যায়, তুমিও তেমন। তুমি বাগবাজারে। তোমার জানলার বাইরে কলকাতা। শ্রাবণের বৃষ্টিধারায় ভিজছে। তোমার নরেনও নেই আর শরীরে। দাহ হয়ে গিয়েছে সে সংসারের বিষে দগ্ধ দেবতনু বেলুড়মঠের মাটিতে। এই ক্ষুব্ধ, অশান্ত, সতত যুযুধান নানা ধর্মীয় মত, নানা বিকার, কুসংস্কারের অন্ধকারে পীড়িত মানুষের হৃদয়কে মুক্তি দিতে, আনন্দবারি দিতে যেন মহাদেব আরেকবার দেহ ধারণ করে নটরাজের নৃত্য করে গেলেন সারা বিশ্বজুড়ে। তারপর হঠাৎ মিলিয়ে গেলেন চর্মচক্ষুর সামনে থেকে। চর্মচক্ষুর আড়ালে গিয়ে মর্মচক্ষুর জ্যোতিকে বললেন, জ্বলে ওঠো। তোমার সে সব কথা মনে পড়ছে। দুইজন মহাপুরুষ, প্রবল শক্তিধর পুরুষ, দু’জন প্রবল কর্মকাণ্ডের পুরোধা পুরুষ তোমায় এই সংসারে একা রেখে আত্মগোপন করলেন, যেন মাঝপথে, অসম্পূর্ণতায়। তুমি পার্থিব দৃষ্টিতে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দহারা। কিন্তু সে শুধুই বাইরের শূন্যতা। অন্তরের নয়। তুমি জানলার কাছে দাঁড়িয়ে। সেদিনের দক্ষিণেশ্বরের মত। তোমার একদিকে নরেন, আরেকদিকে রামকৃষ্ণ – অদৃশ্য, কিন্তু অনস্তিত্ব নয়। তুমি দেখছ কলকাতা ভিজছে। তোমার জানলা থেকে গঙ্গা দেখা যায় না। তবু গঙ্গা খুব দূর নয়। তুমি চাইলেই যেতে পারো। নাইতে পারো। ডুবতে পারো। তুমি চাইলেই যেখানে খুশী যেতে পারো। কিন্তু তোমার দৃষ্টি অসহায়, পীড়িত, ক্ষুব্ধ, অনাথ হৃদয়ের দিকে। তারা লক্ষকোটি তোমায় ঘিরে। বৃষ্টির ধারার মত তোমার উপরে পড়েই চলেছে, পড়েই চলেছে। আজও পড়ে চলেছে। তুমি ছাড়া সইবে কে?
আজও শ্রাবণের ধারায় ভিজছে কলকাতা। আজ সারা পৃথিবীজুড়ে মৃত্যুর তাণ্ডব। মানুষ শঙ্কিত, আতঙ্কিত, ঘরে বাইরে। সেই প্রাচীন যুগের মত সে আবার বলছে, রক্ষা করো... ত্রাণ করো। তার বিশ্বাস সে ত্রাণ পাবে। তার আশ্বাস সে একদিন এই দুর্যোগ কাটিয়ে উঠবেই। কারণ মানুষের বুদ্ধির মধ্যে, হৃদয়ের মধ্যে, কালের গতির মধ্যে একজন মা আছেন, চিরকাল থাকেন। তিনিই রক্ষা করেন, শুভবুদ্ধি দিয়ে, সহমর্মিতা দিয়ে, জ্ঞান দিয়ে – প্রজ্ঞা হয়ে; সর্বমঙ্গলামঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থাসাধিকে... সমস্ত মঙ্গলের মধ্যে যিনি পরম মঙ্গল, সমস্ত শুভের অন্তরে থেকে শুভের সার্থককারিণী... মা তুমি... ঝড়, বন্যা, দাবানল, মহামারী, হিংসা, ক্রুরতা, নিষ্ঠুরতা, বৈরিতা ইত্যাদি সমস্ত অমঙ্গলের মধ্যে যিনি মঙ্গলের দিকে মানুষকে চিরকাল নিয়ে চলেছেন – তিনি মা। তুমি। বরাভয়দাতা। প্রসীদ বিশ্বেশ্বরী পাহি বিশ্বম... হে বিশ্বেশ্বরী... প্রসন্ন হও... এই জগতকে রক্ষা করো... এই শ্রাবণের ধারাপাতে আবার মিশুক সেদিনের মত তোমার করুণাধারা। জ্ঞান প্রজ্ঞা হোক ভালোবাসায়। ভালোবাসা মধুর হোক তোমাতে, মাতৃনামে, মাতৃপ্রেমে, মাতৃস্নেহের অবগাহনে, আশ্বাসে। তুমি জয়ী হও, আবার।