সেদিন ভোর থেকেই রাজধানীতে লোক জমা হতে শুরু হয়েছে। চারিদিকে চাপা উদ্বেগ, কি হবে! কি হবে?
ঘটনার সূত্রপাত আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে। এ দেশের রাজপুত্রের বয়স তখন কুড়ি। তার প্রবল জ্ঞান পিপাসা। কিন্তু তাকে রাজাও তো হতে হবে, তার বাবা তো বৃদ্ধ হয়েছেন। তা রাজত্ব সামলানো আর বিদ্যাচর্চা তো আর একসাথে হয় না! কি করা যায়? ভাবতে ভাবতে তার মনে এল বিদ্যাসুন্দরের কথা। তাকে ডেকে পাঠলে। একান্তে বসে তাকে বললে তার মনের কথা।
তারপর দুই বন্ধু মিলে ঠিক করলে এক প্রকান্ড গ্রন্থাগার বানান হবে। তাতে থাকবে বিশ্বের সব বিষয়ের গ্রন্থ। বিদ্যাসুন্দর সব অধ্যয়ন করে রাজপুত্রকে জানাবেন শ্রেষ্ঠ জ্ঞান কি?
যেমন কথা তেমনি কাজ। তৈরি হল বিশাল গ্রন্থাগার। সারা বিশ্ব থেকে হাজার হাজার বই আসতে লাগল। জাহাজে, ঘোড়ায়, ঊটে - আরো কত পথে। এই ভাবে কত বছর গেল। রাজপুত্র রাজা হলেন, তাঁর বিয়ে হল, রাজপুত্র রাজকন্যা হল। কত যুদ্ধ হল। কত উৎসব হল। বিদ্যাসুন্দর কিন্ত একদিনের জন্যও বেরোলেন না গ্রন্থাগার থেকে। এভাবেই গেল পঞ্চাশ বছর। এ প্রজন্ম কেন, বেশ কয়েক প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা তো রূপকথার মত বিদ্যাসুন্দর-এর গল্প শুনেই বড় হল।
সে যা হোক, অবশেষে জানা গেল অমুক মাসের অমুক তারিখ বিদ্যাসুন্দর বেরোবেন গ্রন্থাগার থেকে। ব্যাস আগুনের মত ছড়িয়ে পড়ল খবর। আজ সেই বিশেষ দিন। পনের দিন আগে থেকেই রাজধানীতে মেলা বসে গেছে। আর আজ তো জনসমুদ্র!
সকাল এগারোটা। গ্রন্থাগারের দরজা খুলল। সবাই উদ্বিগ্ন, এমন কি কোলের শিশুগুলোও যেন বুঝতে পেরেছে। সব চুপ। ওই, ওই তো বিদ্যাসুন্দর! বয়সের ভারে ঝুঁকে পড়েছে, সাদা চুল, শীর্ণ দেহ, কিন্ত মুখে কি একটা অপার্থিব হাসি! কাঁসর, ঘন্টা, কাড়া-নাকাড়া আরো কত কি বেজে উঠল! বিদ্যাসুন্দর রথে উঠলেন, চললেন রাজসভার দিকে। পিছনে চলল জনজোয়ার!
রাজা বসে গভীর উত্তেজনায়! আজ তাঁর জীবন সার্থক হতে চলেছে, আজ তাঁর পরম প্রাপ্তি। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জ্ঞান! আহা!
বিদ্যাসুন্দর রাজসভায় প্রবেশ করলেন। সবাই উঠে দাঁড়ালেন, এমনকি স্বয়ং রাজাও। বিদ্যাসুন্দর কম্পিত দেহে ধীরে ধীরে সিংহাসনের কাছে উঠলেন। রাজা তাঁকে আলিঙ্গন করে পাশে বসালেন। তারপর তিলক আর মালা পরিয়ে তাঁর অভ্যর্থনা করলেন। বললেন, “হে বন্ধু, তোমার কাছে আমি তথা সমস্ত দেশ আজ কৃতজ্ঞ বন্ধু! বলো, তুমি পেয়েছ সে শ্রেষ্ঠ জ্ঞান যাতে মানুষের পরম কল্যাণ আর পরম তৃপ্তি!”
বিদ্যাসুন্দর বললেন, “হ্যাঁ বন্ধু। এই বলে তিনি একটি সুবর্ণ মণি-মুক্তাখচিত বাক্স রাজার হাতে দিলেন।”
রাজা বাক্স খুলে দেখলেন তাতে ভারী সুন্দর ছোট একটা আয়না। তারপর দুই বন্ধু গলা জড়িয়ে খুব কাঁদলেন হাসলেন।
সৌরভ ভট্টাচার্য
17 November 2013