উঁচু পাতা থেকে বৃষ্টির জল বিন্দু বিন্দু নীচু পাতার বুকে এসে পড়ছে। নীচু পাতা একটু কেঁপে উঠে সে জলকে বুকে জায়গা দিয়ে স্থির হতে চাইছে। খানিক পরেই সে জল গড়িয়ে মাটিতে পড়ছে - বিন্দু বিন্দু। পাতা আটকাচ্ছে না। আকাশের দিকে তাকিয়ে সে, সেখানে মেঘের ঘনঘটা।
মাটিতে জলের স্রোত। সে জল গিয়ে পড়ছে বোসেদের দীঘিতে। সে দীঘির জলে কালো আকাশের ছায়া। তার চারদিকের নারকেল গাছগুলো একদিনের বৃষ্টিতে ভিজে চাপচাপ হয়ে আছে।
জানলার উপর গীতাটা রাখা। আজ স্নান নয়, ঠাণ্ডা আছে। শাড়িটা বদলে রোজকার দিনের মত জানলার সামনে বসে। ধুপের গন্ধটা ভীষণ সুন্দর। একটা বেড়াল ভিজছে। কুকুরগুলো যেন ভীষণ অস্থির। আজ রবিবার। অনেকের বাড়ি মাংস হয়। সবাই জানে। রাঁধার সুখ্যাতি ছিল পাড়ায় বর্ষার, এখন হাত-পা নিজের ইচ্ছায় নাড়ানো যায় না। কারোর বাড়িতে শাঁখ বাজছে। কেন? আজ কি কোনো পুজো?
"বউদি একটু পা'টা তুলুন"
তুলি, ঝাঁট দিচ্ছে। কত বছর হল এ বাড়িতে কাজ করছে, তবু অচেনা। একটা গল্পের বইয়ের মত। তার জীবনকে ছুঁয়ে দেখা যায় না, কয়েকটা পাতা উল্টালেই একঘেয়ে, অভাবের গল্প, এখন আর ভালো লাগে না। অভাব কি শুধু টাকাপয়সার অভাবেই...
"বউদি, আজ কেমন আছ?"
তার দেওর। মাথাটা অল্পবিস্তর ছিটেল। কিছুই জীবনে গুছিয়ে করে উঠতে পারল না স্থির হয়ে। ছেলেটা দাঁড়িয়ে গেছে তাই রক্ষে। এখন আবার গর্ব, ছেলেকে নিয়ে। মূর্খের গর্ব বড় বালাই। বর্ষা হেসে মাথা নাড়ল।
"আজ কি একটু ছাদে যাবে? বৃষ্টিটা ধরেছে খানিক।"
তার সামনে তার স্বামী। ভর্তা। বর। তার শরীরের একছত্র অধিপতি। মালিক। পরমগুরু। সংসারের সবচাইতে অপরিচিত মানুষ যে, সে তার সামনে দাঁড়িয়ে, স্নান করে, যোগা করে এল। রিট্যায়ারড রেলওয়ে ম্যান। ভালো মানুষ। তার চোখের দিকে তাকালে নিজের জীবনটাকে ভীষণ ক্ষুদ্র মনে হয়, নিজেকে অকিঞ্চিৎকর মনে হয়। ওর চোখে তার জীবনের মূল্য রান্নাঘর, শোয়ার বিছানা, ছেলেমেয়ের দায় নেওয়া চলমান দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন জান্তবতাতে।
বর্ষা হেসে বলল, "থাক।"
তার হাসিমুখের দাম এ সংসারে প্রচুর। সেটা বাড়ির শ্রী। তার উপর নির্ভর করে। তার উপর ঠিক না, তার হাসিমুখের উপর। অন্তর্যামী তার হাসি দেখে বিস্মিত হন হয়তো, যে হাসি আমি আমার ঠোঁটের গোড়ায় আনতে পারছি না, সে হাসি তুই আনিস কি করে বর্ষা?
রান্নাঘরের কুকারে সিটি পড়ল। আজ ঘুগনি হবে, আর লুচি। রবিবারের এই নিয়ম। আবার বৃষ্টি শুরু হল। এখন জয়ন্ত এ ঘরে আসবে, নিজের প্রেডিকশন ভুল জানান দিতে। পুরুষ মানুষেরা এত তুচ্ছ জিনিসে নিজের ইগো জড়িয়ে ফেলে কেন?
"বুঝলে, ছাদে ওঠোনি ভালোই হয়েছে... বৃষ্টি শুরু হলে এই হুইলচেয়ারশুদ্ধ তোমায় নামানো কি চাট্টিখানি কথা, বলো... হা হা..."
এ বিদ্রুপের হাসি নয়, নিজের ইগোর সাথে লড়াইয়ের হাসি। জয়ন্ত ভাবছে সে হেরে গেছে, তার কাছে। পুরুষমানুষ কেন হারজিতের বাইরে যায় না? যেতে পারে না, নাকি যেতে চায় না?
দীঘির জলের উপর ঝমঝম করে পড়ছে বৃষ্টির ধারা। মায়ের মুখটা মনে পড়ছে। বর্ষার মা, দ্যুতি। লোকে বলত ক্ষ্যাপা, অলক্ষ্মী, বাউণ্ডুলে, নষ্ট। গায়ে মাখত না মা। বলত, কচুপাতায় জল দাঁড়ায় না। তোমরা জল, আমি তেল, মিশবে না। আসলে মা মেয়ের থেকে মানুষ ছিল অনেক বেশি। অত স্বাধীনসত্তা মানুষটার মেয়ে হয়ে আর বামুন বাড়ির বউ হয়ে যে ক্ষতিপূরণ দিতে হয়, দিয়েছিল। কিন্তু সারাজীবন নিজের মতেই বেঁচেছিল। অসুস্থ হল। বাবা কলকাতায় নিয়ে আসতে পারত, এখন মনে হয় ইচ্ছা করেই আনেনি। বাবাও ছুটি চাইছিল। ছুটি পেল, কিন্তু মানুষটা কেমন যেন গুটিয়ে নিল নিজেকে। যে মানুষটা বেঁচে থাকতে মায়ের পাশে দাঁড়ালো না কোনোদিন, সেই মানুষটাই মায়ের মারা যাওয়ার পর মায়ের পাশে দাঁড়ালো। সবকথার উত্তর আছে সেদিন বাবার কাছে। শুধু উত্তর না, ব্যঙ্গের উত্তরে ব্যঙ্গ, বিদ্রুপের উত্তরে বিদ্রুপ, সব আছে। মা ঠিকই বলত, তোর বাবা ভালোমানুষ, কিন্তু ভীতু।
"ঠাম্মি তোমায় খাবারটা এখানে দেবে, না খাবার টেবিলে আসবে? মা জিজ্ঞাসা করল।"
রন্তু, নাইনে পড়ে, তার নাতি। দুই ছেলে এক মেয়ে বর্ষার। সবাই সংসারী। বড়ছেলের ছেলে রন্তু, ছোটোছেলের মেয়ে তিন্নি, ফাইভে পড়ে। সে ঘুমকাতুরে, এখন উঠবে না।
"না রে বাবু, আমি যাব না, আমায় একটু পরে মুড়ি আর তরকারি দিতে বলিস..."
পুরোটা শুনল না, নাচতে নাচতে বেরিয়ে গেল রন্তু।
কিভাবে অশোক আর অবনীকে মানুষ করল বর্ষা? আসলে কেউ কাউকে মানুষ করে না। এটা ভুল কথা একটা। মানুষ নিজেকে কৃতিত্ব দেবে বলে সংসারে কত যে মিথ্যাকথার বাগান সাজিয়ে রেখেছে! প্রতিটা মানুষ জন্মের সময় থেকে একটা ধাত নিয়ে জন্মায়। নইলে অবনী আর অশোক এত আলাদা স্বভাবের হয় কি করে? মানুষ করা মানে কয়েকটা নুড়িপাথর কুড়িয়ে ফেলা, আগাছা পরিষ্কার করা, যাতে নদীটার চলতে অসুবিধা না হয়। সেইটুকুই। নইলে তার গতিপথ নির্ধারণ করার ক্ষমতা কারোর আছে? তার নিজেরই কি আছে? নেই। প্রতিটা মানুষ ঝর্ণার মত। তার গতির বেগ নির্ধারিত হয়েই আছে পাহাড়ের উচ্চতায়। সে কি বদলাতে পারে? বর্ষা শুধু অববাহিকা পরিষ্কার করেছে অবনী আর অশোকের। তারা যে কুপথে যায়নি, সে তার ভাগ্য, কৃতিত্ব নয়। কোন বাবা-মা চায় তার ছেলেমেয়ে নষ্ট হোক, তবু হয় তো!
খুব জোর বাজ পড়ল একটা। বোসেদের দীঘিতে স্নান করতে নেমেছে কয়েকটা বাচ্চা। স্টেশানের কিছুটা দূরে একটা বস্তি আছে। সেখানকার বাচ্চা। তুলির ছেলেটাও আছে? একবার মনে হল ডাকে, তারপর ভাবল থাক। বাপ মরা ছেলে। বাপ মরা ছেলের মায়ের শাসনে ভালোবাসার থেকে উদ্বিগ্নতা থাকে বেশি। খেলুক ছেলেটা।
বর্ষার নিজেকে অচেনা লাগে। এ সংসারের সব মানুষকে অচেনা লাগে। নাড়ি কেটে জন্মায় তো একটা শরীর, মানুষটা তো না। তাই সে ছেলেমেয়ে.... আচ্ছা অদিতির কথা তো ভাবছে না... আজ আসার কথা না.....
"মা....."
অদিতি! বুকের ভিতরটা চলকে উঠল বর্ষার... অদিতির হাতে লুচি আর ঘুগনি...
"মুড়ি কেন খাবে?"
"না অম্বল..."
"সেই একবার বমি করে ফেলেছিলে বলে এখনও তুমি লুচি খাবে না?.... মা আমরা বমি করিনি?.... তুমি পরিষ্কার করোনি?.. সেই ভয়ে... কেন?... তুমি নিজে উঠে পরিষ্কার করতে পারবে না বলে?...."
"চুপ কর... চুপ কর..."
বাইরে ছেলেগুলো দীঘির জলে লাফাচ্ছে.... যে দীঘির জলে মেঘের ছায়া... যে মেঘ আকাশের অতিথি... না, আকাশের কন্যা...
অদিতি বর্ষার চোখের কোল মুছিয়ে দিচ্ছে... একটু একটু করে লুচি ছিঁড়ে ঘুগনি দিয়ে তার মুখে দিচ্ছে...
"একটু বেশি নুন হয়ে গেছে, না মা?...."
বর্ষা মাথা নাড়ল.... যার মানে 'না' বা 'হ্যাঁ' কিছুই বোঝায় না.... সংসারে এমনভাবেই মাথা নাড়া অভ্যাস তার... যার মানে 'না' বা 'হ্যাঁ' কিছুই হয় না.... এর কোনোটাই আসলে সে পুরো নয়... না তো 'না'... না তো 'হ্যাঁ'.... মানুষ তার থেকে অনেক বেশি... যেখানে ক্ষমা... যেখানে ভালোবাসা... যেখানে প্রশ্রয়... যেমন দীঘির জলে আকাশ ধরানোর সাধ... এ প্রশ্রয় ছাড়া কি... হোক সে ছায়া... হোক সে ক্ষণিকের.... তবু এই ভালোবাসা.....
এক টুকরো লুচি কাঁপা হাতে বর্ষা অদিতির মুখে তুলে দিল... অদিতি হাত বাড়িয়ে কাঁপা হাতটা শক্ত করে ধরে বলল.... "তোমার জামাই বলে তুমি আমার চাইতে বেশি সুন্দরী...."
বর্ষা হাসতে হাসতে বলল, "যা...!"
হাসিটাই সংসারে শ্রী.... তাই না? ভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে বর্ষা মনে মনে বলল....