Skip to main content

মাদার টেরেসা 'সন্ত' উপাধি পেলেন। অমনি একদল লোক 'হাঁ হাঁ' করে চীৎকার চেঁচামেচি জুড়ে দিলেন। “আরে আরে কি করো কি করো? উনি ভারতের দরিদ্রতাকে মার্কেটিং করেছেন, উনি মানুষের দরিদ্রতার সুযোগ নিয়ে তাদের ধরে ধরে খ্রীষ্টান করেছেন, ওকে নিয়ে এত বাড়াবাড়ি কোরো না..." ইত্যাদি। মনে পড়ে গেল অস্ট্রেলিয়ান মিশনারীর কথা, গ্রাহাম স্টেইন, যিনি তার স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে কুষ্ঠরোগের বিরুদ্ধে নেমেছিলেন, ২৩শে জানুয়ারি ১৯৯৯ সালের মধ্যরাতে ছয় ও দশ বছরের দুই পুত্রসন্তানসহ তাকেও একটি গাড়িতে জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মরতে হয়। ঘটনাটি ঘটিয়েছিল উগ্রহিন্দুপ্রেমী দারা সিং, বজরঙদলের। তার স্ত্রী বলেছিলেন, 'আমার ওদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই, বিচার ঈশ্বর করবেন।' আমার মাথা নীচু হয়ে এসেছিল যে ধর্মে বিশ্বাস করে তিনি এটা বলতে পেরেছিলেন সেই ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধায়।

আমার মামাবাড়ি উড়িষ্যার একটা খরা কবলিত এলাকায়। সেখানে দরিদ্র আদিবাসীদের সংখ্যা কম না। আগেও বলেছি, আমার দাদু সেখানকার সরকারী হাসপাতালের ডাক্তার ছিলেন। সেই গ্রামে ওই একঘরমাত্র বাঙালী পরিবার। মা বড় হন সেই গ্রামে। মায়ের মুখে শুনেছি, ওই গ্রামের যারা অচ্ছুৎ, নীচুজাত, যাদের ছায়া মাড়ালে আক্ষরিক অর্থে স্নান করতেন সমাজের উচ্চবংশীয় মানুষেরা, সেই সব উপেক্ষিত বঞ্চিত মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল খ্রীষ্টান মিশনারীরা। মা বলতেন, মজার কথা কি জানিস বাবু, যে মানুষটা হিন্দু অবস্থায় অচ্ছুৎ ছিল, সে-ই খ্রীষ্টান হওয়ার পরে তথাকথিত ভদ্রলোকেদের বাড়িতে আমন্ত্রিত হওয়ার অধিকার পেত।
আমার ‘চণ্ডালিকা’র নাটকটার কথা মনে পড়ত শুনলেই। মেয়েটা সমাজে বারবার লাঞ্ছিতা হয়ে যখন বিদ্রোহ করে গেয়ে উঠছে, “কেন দেব ফুল আমি সেই দেবতায়?”...


আমি বড় হয়েছি হাওড়ায়। সেখানে আমাদের বাড়িতে জল দিতে আসতেন দুর্যোধন বলে একজন উড়িয়া ভারী। একদিন তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলুম, "হ্যাঁ গো তোমার নাম এমন একটা খারাপ লোকের নামে কেন? তোমার নাম যুধিষ্ঠির, অর্জুন, কৃষ্ণ ইত্যাদি হতে পারত।"
সে বেচারা আমার মুখের দিকে 'হাঁ' করে তাকিয়ে ছিল। আমি যখন একটা একটা নাম উচ্চারণ করছিলাম, সে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে, যেই 'কৃষ্ণ' নামটা উচ্চারণ করলাম সে আঁৎকে উঠে কানে আঙুল দিয়ে বলল, “আরে আমরা ছোটোজাত বাবু, আমাদের ওসব নামে কি অধিকার? ওসব নাম আপনাদের মানায়। আমাদের ছেলেমেয়েদের নাম গুখাই, মুতখাই রাখলেই চলে যায়।“ বলে সে হাসল। কি করুণ সে হাসি। আমার আজও মনে পড়লে বুকের কাছটা টনটন করে ওঠে।
সেই প্রত্যন্ত গ্রামে মিশনারীরা একটা উন্নত মানের হাসপাতাল করেছিলেন অতদিন আগে। কি অক্লান্ত সেবা করতেন ওই পান্ডববর্জিত গ্রামে, সে না দেখলে বিশ্বাস হওয়ার নয়।


আরেকটা কথা মনে পড়ল। একটা বাচ্চা মেয়ে, নাম ইডা স্কাডার। বাবা ডাক্তার। দক্ষিণ ভারতের একটা গ্রামের চিকিৎসক তিনি। একদিন রাতে একজন পুরুষ দুই আসন্নপ্রসবা মহিলাকে গরুর গাড়ি করে নিয়ে আসেন। দুজনেই যন্ত্রণায় ছটফট করছেন। ইডা স্কাডারের বাবা যখন তাদের দেখতে এগোচ্ছেন, তখন সেই পুরুষ বাধা দিয়ে বললেন, "না আপনি ছোঁবেন না, আপনি পরপুরুষ। আপনি বলুন কি করতে হবে, আমার দাই করবে।"


শেষরক্ষা হল না। দু'জনেই মারা গেলেন। ইডা স্কাডারের বুকে যেন একটা তীর বিঁধে রইল। সেদিন রাতেই ঠিক করলেন, তিনি ডাক্তার হবেন। হলেনও। ফিরে এলেন এ দেশে। সেই গ্রামে। একটা গরুর গাড়ী নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে গিয়ে সুরক্ষিতভাবে প্রসবের ভার নিলেন গ্রামের ওই অশিক্ষিত মানুষদের শিখিয়ে পড়িয়ে। একটা ছোট্ট কুঁড়েঘর বানালেন। কয়েকটা বেড তাতে। সেই তাঁর হাসপাতাল। ক্রমে আজই সেটা বিশ্বের প্রথম সারির চিকিৎসালয় - CMC VELLORE, বাঙালীকুলের চিকিৎসার পরম তীর্থকেন্দ্র।


আসলে মুলে একটা বড় প্রভেদ আছে। বাইবেলের কিছু কথায় আসা যাক। একটা ঘটনা আছে, একবার যীশু একটা অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষদের বস্তির দিকে যাচ্ছেন। তার সঙ্গীসাথীরা বললেন, 'আরে কি করেন প্রভু, ওরা যে নীচ! অপরাধপ্রবণ!' যীশু বললেন, 'হতে পারে। আর তাই ওদের জন্যেই তো আমার আসা! ধরো একজন বাবার দশটা ছেলে আছে। সবাই ভালো কিন্তু একজন বিপথগামী। বাবার মন কার দিকে পড়ে থাকবে? আর সেই ছেলে যদি কোনোদিন ফিরে আসে সুপথে, তবে বাবা তার সবচাইতে ভালো ভেড়াটা কেটে সেদিন ভোজের আয়োজন করবেন।'
এবারে আমাদের গীতার দিকে তাকান, ‘সেখানে কিন্তু বলা হচ্ছে, আমার আসার কারণ হল সাধুদের পরিত্রাণ আর দুর্জনের সংহার। আর বলা হচ্ছে, যদি তুমি আমাতে মন দাও তবে তোমায় গিয়ে উদ্ধার করা হবে।‘


আবার আসা যাক বাইবেলে, সেখানে বলা হচ্ছে, ‘আমায় নৈবেদ্য দেওয়ার আগে যদি তোমার মনে হয় তোমার কোনো ভাইয়ের তোমার বিরুদ্ধে কিছু বলার আছে, তবে আগে সেটা মিটিয়ে এসো। তারপর নৈবেদ্য দিও।‘ আরেকটা উদ্ধৃতিতে আসা যাক, সেখানে বলা হচ্ছে, ‘ঈশ্বরের সবচাইতে বড় আদেশ দুটো, এক ঈশ্বরকে ভালোবাসো। দুই তোমার ভাইকে নিজের মতই ভালোবাসো।' বলা হচ্ছে, ‘তুমি যদি তোমার ভাইয়ের অপরাধ ক্ষমা করো, তবেই তোমার অপরাধ ক্ষমা করা হবে' ... বলা হচ্ছে, ‘একজন দুঃস্থ অসহায় মানুষকে যদি উপেক্ষা করো, তবে আমিও বলব তোমায় আমি চিনি না', তুমি তখন বলবে, 'কেন প্রভু আমি কি তোমার নাম করিনি? আমি তোমার নামে ব্রত উপবাস করিনি?' আমি বলব, 'আমি যখন তৃষ্ণার্ত হয়ে তোমার পাশে এসেছিলাম তুমি জল দাওনি, ক্ষুধার্ত হয়ে তোমার পাশে এসেছিলাম তুমি খাবার দাওনি, নগ্ন হয়ে তোমার পাশে এসেছিলাম, তুমি আমায় বস্ত্র দাওনি।‘


আমাদের প্রথা কিন্তু তা নয়। আমরা বিশ্বাস করি, 'একবার কৃষ্ণনামে যত পাপ হরে, জীবের সাধ্য নাই তত পাপ করে'। অতএব পাপও চলুক, কৃষ্ণনামও চলুক। অথবা যত পাপই করো না কেন, তিথিনক্ষত্র দেখে অমুক নদীতে অমুক দিক ফিরে ডুব দাও তো সব চুকে গেল। ব্যস। একজন বেশ মজা করে বলতেন, 'আমাদের দেশে প্রথম দুর্নীতি কি করে ঢুকল জানেন? গণেশ আর কার্তিক - কে মা'কে বেশি ভালোবাসেন। এ গল্প আমাদের অনেকেরই জানা। কার্তিক বহুদিন ধরে সারা বিশ্ব পরিভ্রমণ করে এলেন, আর গণেশ শুধু মা'কে পরিভ্রমণ করেই মায়ের গলার হারটা পেয়ে গেলেন। অর্থাৎ আমরা শ্রদ্ধার আড়ালে Short Cut খুঁজতে শিখে গেলাম।


একটা কথা খুব ভালোভাবে বিচার করলে দেখা যাবে, বিবেকানন্দ, গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথের চিন্তাদর্শে যে নব্যভারতীয় দর্শনটা তৈরি হয়েছিল, তা বহুলাংশে পাশ্চাত্য ধর্ম ও দর্শন দ্বারা অনুপ্রাণিত। এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার জায়গা এটা নয়। রবীন্দ্রনাথের 'খ্রীষ্ট', 'বড়দিন' ইত্যাদি প্রবন্ধগুলো পড়ে দেখার অনুরোধ রইল। গান্ধীর তো পুরো জীবন-দর্শনটাই বাইবেলের অহিংসা নীতির উপর। যা তিনি টলস্টয়ের 'The Kingdom of God is Within You' বই থেকে পান। আর বিবেকানন্দ'র ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। তার শুধু উল্লেখমাত্র করা যেতে পারে, নয়তো দীর্ঘ হয়ে উঠবে আলোচনা। বিবেকানন্দের প্রচারিত ধর্মের একটা বড় দিক, স্বনির্ভরতা – যা বুদ্ধ দ্বারা অনুপ্রাণিত, যেখানে বিবেকানন্দ প্রায় নাস্তিকতার সমর্থনে এসে পৌঁছান। দুই, তাঁর সেবাধর্ম, যা ভীষণভাবেই খ্রীষ্টধর্ম দ্বারা প্রভাবিত। এমনকি প্রথমদিকে মঠেও এই নিয়ে অশান্তি হয়। সারদা দেবীর মধ্যস্থতায় তা মেটে। বিবেকানন্দ এই দুটো দিকের ভাবকেই ঔপনিষদিক ব্যাখ্যায় ঢেলে করেছিলেন হিন্দুধর্মের আঙ্গিকে। এবং মনে রাখতে হবে তার এই কাজে সম্পূর্ন নিঃস্বার্থভাবে যাকে পাশে পেয়েছিলেন তিনি একজন বিদেশি নারী - সিস্টার নিবেদিতা (এবং মঠ ও মিশন তৈরিতেও বেশিরভাগ অর্থ এসেছিল সেই ম্লেচ্ছদের থেকেই), কেন দেশে কি তখন আমাদের নারীর অভাব ঘটেছিল?


এই কথাগুলোর অর্থ এই নয়, ওদের সব ভালো, আমাদের সব খারাপ। আমি কিন্তু চার্চ মন্দির মঠ মিশনের আলোচনায় যাচ্ছি না। সেখানে মেলা গোলমাল। আমি বলতে চাইছিলাম, দুটো ধর্মের মূল দৃষ্টিভঙ্গীতে। আমাদের ধর্মে পরজগত, আত্মার অমরত্ত্ব, নিজের মুক্তি ইত্যাদিতে আমরা এত ব্যস্ত যে পাশের মানুষ মরুক কি বাঁচুক অতটা আমাদের মাথাব্যথা নেই। মানবিক দিকটা Mysticism আর Metaphyics -এর চক্করে অনেকটা হতপ্রায়। তাই অনায়াসে আমরা সতীদাহ অবধি মেনে নিতে পেরেছিলাম ধর্মে দোহাই দিয়ে। কোনো তুচ্ছাতিতুচ্ছ অপরাধে, ‘তপ্ত ঘৃত খেয়ে প্রাণত্যাগ করুন’ বলতে জিভ কাঁপেনি। এহেন উদাহরণ দিতে শুরু করলে রাত্তির কাবার।


আজও দেখেছি, পাহাড়ে গুহায় নদীতীরে অতিজাগতিক ক্ষমতাসম্পন্ন বাবাজী খোঁজার কি হিড়িক! একটা মোবাইল এনে যদি কেউ বলে এটা আমাদের দেশে তৈরি, অমনি মনের ভিতর থেকে সব ভরসা উবে যায়, মনে হয়, থাক পয়সাই যখন দেবো একটা বিদেশী কোম্পানীকেই দিই, অন্তত ঠকব না। এমনই স্বদেশের উপর আমাদের আস্থা! যত আস্থা ওই বাবাজী আর ভেল্কিবাজিতেই। ওর বেশি কিছু চাইতে হলে, কালাপানী পেরোতেই হয়েছে - ইতিহাস সাক্ষী।


যে প্রসঙ্গে এতগুলো কথা, তাই বলছিলাম, অকারণে গুমোর দেখিয়ে লাভ কি ভাই? নবীন চাওলা ওনার একটা জীবনী লিখেছেন সেটা পড়ে দেখা যেতে পারে। আমি নিজে ওদের সাথে বহুবার কথা বলেছি, গেছি, অমনধারা কিছু তো বলেন নি আমায়। বরং আমি পরীক্ষার্থে তাদের প্ররোচিত করার চেষ্টা করলেও, তারা আমায় বিরত করেছেন দেখেছি।


আরেকটা কথা বলে শেষ করি। একজন খ্রীষ্টের সাধককে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, 'আমি যদি আমার মহল্লায় খ্রীষ্টের কথা বলতে চাই, তবে শ্রেষ্ঠ কথাটা কি হবে? উনি বলেছিলেন, 'Spread the message of love only.'
অবাক লেগেছিল। কারণ কোনো মঠে-মিশনে এমনধারা কথা শুনিনি। যতই আমাদের অদ্বৈতবাদে গলা শুকাক না কেন, সেখানে তুমি গৃহী আর আমি সাধু, দূর হটো! ছুঁয়ো না। ওই কাঁচের বাইরে থেকে দেখো... অশুচি না তুমি! আর আমি হাগামোতা শরীর ছোঁব কি? ওদের কর্মফল ওরা পাচ্ছে... আর দান করবে কেন? সেই টাকা নিয়ে যদি সে পাপ করে, সেই পাপ তো তোমারও হবে... মনের অবস্থা ভালো নয় তো ওকে মানসিক ডাক্তার দেখাও... মঠে নিয়ে এসেছো কেন? ...


থাক কথা বাড়িয়ে আর লাভ নেই। এমনিতেই অনেক শত্রু বাড়ালাম বুঝতেই পারছি। তবে হ্যাঁ, 'ওঁ ঐং মাদার টেরেসাওই নমঃ’ বলে কোনো মন্ত্র বেরোলে আমি জানাবো। যাতে পাপশুদ্ধি হয়। দানের পূণ্য মেলে। মনে শ্মশানের মত শান্তি মেলে। আর উনি যেসব কাজ করেছেন ওসব আমাদের মানায়? আসুন ধ্যানে বসি। কে মরল, কে রোগে অনাহারে আছে ওসব দেখে কি হবে মশায়? আপনার আমার চাই ঈশ্বর দর্শন আর মুক্তি; আর ঈশ্বরের নামে যেন গ্যালন গ্যালন জল বেরোয় চোখ থেকে, এমন ভাব হয় যেন প্রায় আইসিইউ-তে নিয়ে যাওয়ার যোগাড় হয় – তবে হল কিনা ধর্ম?