জিজ্ঞাসা করলাম, এই যে বাড়ি হচ্ছে, এ কার বাড়ি?
চারদিক সবুজ আর সবুজ। ধানক্ষেত। তার একদিকে বড় বেমানান এক পেল্লায় বাড়ি তৈরি হচ্ছে।
উনি হেসে উত্তর দিলেন, বাড়ি নয় গো..স্কুল।
মানুষটার মাথা আর কান, অদ্ভুত সব রঙে, হাতে বোনা মাফলারে ঢাকা। গায়ে তিনটে জামা একের উপর এক। গলার কাছে তিনটে রঙের কলার পর পর, তিনরঙা। নীল লুঙ্গি। পায়ে রাবারের জুতো। হাত-পাগুলো দেখে মনে হবে ঝড়ে মরে যাওয়া একটা গাছের কাণ্ড যেন দীর্ঘদিন রোদে-জলে দাঁড়িয়ে, অগুনতি বছর ধরে। যত্ন পায়নি। অবহেলাকে স্পর্ধায় এড়িয়ে গেছে শুধু।
বললাম, কেমন আছেন?
আবার হাসলেন। একজন অপরিচিত মানুষকে দেখলে যে সৌজন্য হাসি, এ তা নয়। এমন এক সরল হাসি, যে আমায় অপরিচিত জানে, কিন্তু অতি-সতর্কতায় আমায় ক্ষতিকারক বলে মানে না। বললেন, আর কেমন আছি, এই যে বেঁচে আছি, এই তো অনেক!
কি আশ্চর্য কথা। “আসছি” বলে এগিয়ে গেলাম। ও কথার তো কোনো উত্তর হয় না।
ধানক্ষেতের মাঝে এসে দাঁড়ালাম। স্কুলবাড়ি উঠছে। পাশে ঝোলানো বিজ্ঞাপন। ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল। আপাতত ক্লাস ফাইভ অবধি, তারপর বেড়ে হবে বারো ক্লাস অবধি।
বড্ড বেমানান। এই খেটে খাওয়া মানুষের সার দেওয়া পর পর বাড়িগুলোকে দুপাশে রেখে স্কুলবাস ঢুকবে একে একে কদিন পরে “প্রিভিলেজড” বাচ্চাদের নিয়ে। যাদের একদিনের খরচ, এ পাড়ার বাচ্চাদের হয় তো বা সারা মাসেরও না। যাদের বায়নাকে এদের দুরাকাঙ্ক্ষাও দুঃস্বপ্ন হিসাবে দেখে। তবু আসবে ওরা। এরা জড়োসড়ো হয়ে, গুটিশুটি মেরে কুঁকড়ে পাশে সরে গিয়ে রাস্তা করবে। এদের কারুর কারুর বাড়ির লোক হয় তো দোকান দেবে চা-বিস্কুট, কি লজেন্স ফুচকার। ওদের জন্যে না। ওদের দিতে নিতে আসা গাড়ির ড্রাইভারদের জন্য। কাজের লোকেদের জন্য। কিম্বা যদি ওই বাচ্চাদের কেউ আসে বেড়াজাল টপকে শাসনের, অভ্যাসের, আদবকায়দার…. সেই আবদারী প্রত্যাশায়।
ধীরে ধীরে আরো বাকি মাঠ কেনা হবে। বিল্ডিং বাড়বে শিক্ষার সুদূরতার সঙ্গে এক্কাদোক্কা খেলতে খেলতে অনায়াসে। কি সস্তা জমি এদিকে! একটা একটা করে টালির বাড়ি, টিনের বাড়ি, লোকনাথবাবার মন্দির ইত্যাদি হারিয়ে যাবে। এই সবুজ মাঠ আর নীলাকাশকে উপেক্ষা করে, জীবনানন্দ, রবীন্দ্রনাথকে দ্বিতীয় স্থানে রেখে, কি উহ্য করে একেবারে, একে একে আসবে ইংরেজি কবির দল।
ঈর্ষা করি না। সঙ্কীর্ণ করি না মন। কষ্ট পাই। জমি হারানোর কষ্ট। একদিন হয় তো সব বাংলা বই চুপ করে যাবে এইভাবে। শখে শেখা ভাষা আবার কোন শখে চাপা পড়ে যায়, কে বলতে পারে? শখের তো কোনো প্রতিশ্রুতি হয় না।
ভাবতে ভাবতে সন্ধ্যে হল। গোটা মাঠকে, ক্ষেতকে, আকাশকে নির্বান্ধবপুরী মনে হচ্ছে। ওই মানুষটা লাঠিতে ভর করে করে, সন্ধ্যের অন্ধকারকে মেপে মেপে, স্কুলবাড়িকে তোয়াক্কা না করে চলেছে নিজের বাড়ির দিকে। যে বাড়িতে কেউ একটাও ইংরেজি কবিতা জানে না। কোনোদিন বুঝতেও পারল না যারা, তারা কি ব্যর্থ জীবনকে এতটা আনন্দে, এতটা প্রাণপ্রাচুর্যে বয়ে নিয়ে এলো এতটা পথ। যদি জিজ্ঞাসা করো, কি পেলে? অবাক হয়ে হেসে বলবে, পাওয়ার কথা ছিল বুঝি? বাঁচার না শুধু?!
মানুষটা সরু সরু দুটো কালো পা আলের উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কি আত্মীয়তায় ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। কি অনাড়ম্বর অধিকারবোধ ওর। শরীরের ভঙ্গিতে এমনই সরল স্বাচ্ছন্দ্য, অক্সফোর্ড ডিকশনারির “কনফিডেন্স” শব্দেও অত বিশ্বাস নেই যেন। অথচ সে জানেই না তার ভাষা আর জমি দুই-ই বিক্রি হয়ে গেছে উন্নতির নিলামশালায়। সে একা। আরো একা হয়ে যাবে। অথচ এতটুকু সঙ্কোচ, কি ভয় নেই ওর। এত স্পর্ধা!