রীতার মাথাটায় একটা ঝাঁকুনি লাগছিল। মাথার ভিতরটা এখনো ঝিমঝিম করছে। চোখ খুলতে ইচ্ছা করছে না। গা'টা পাক দিচ্ছে। আশেপাশে রিকশা, স্কুটার, সাইকেলের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, বুঝতে পারল। ধীরে ধীরে চোখ মেলতেই বুঝল, সন্ধ্যা হয়ে গেছে। স্ট্রীটলাইটগুলোর আলোগুলো কেমন তেরছা হয়ে তার চোখে লাগছে। তাকে ধরে কে বসে আছে? চোখ মেলে বোঝার চেষ্টা করল। ও, লতা। তবে কি এটা ওর বরের ভ্যান রিকশা?
রীতার নড়াচড়াটা লতার চোখ এড়ায়নি। সে তাড়াতাড়ি রীতার কানের কাছে মুখ এনে বলল, "কিরকম লাগছে গো বৌদি?"
রীতা কোনো কথা বলল না। নাকের কাছটা অসহ্য ব্যাথা। রক্তটা শুকিয়েছে? একবার হাত দিয়ে দেখার চেষ্টা করতে গেল। পারল না। হাতটা তুলতে পারছে না। হাতটাও ভাঙল?
লতা কানের কাছে মুখ এনে বলল, "আসল ঘটনাটা বোলোনি কিছু বৌদি ডাক্তারকে। বোলো সিঁড়ি দিয়ে পড়ে গেছো।"
রীতা মুখটা ঘুরিয়ে নিল উল্টোদিকে। চোখ বন্ধ করল।
আসল ঘটনাটা কি বলি। রীতা আর ওর বর যুগল এই মাস ছয় হল কল্যাণীর খালপাড়ের ধারে একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকে। বাড়ি বলতে ঝুপড়ি। মণ্ডলদের। মণ্ডলদের বাড়িও নোয়াখলিতে। তাদের গ্রামের পাশেই। রীতার বিয়ে হয়েছে সাত আট মাস হল। সে তিনটে বাড়ির কাজ ধরেছে। আর যুগল জোগাড়ের কাজ শুরু করেছে। রীতার বড় ভাশুর বলাই আর তার বড় জা মালতী এই ক'টা বাড়ি পরেই আরেকটা ঝুপড়িতে থাকে। সমস্যাটা হল তাদের গ্রামের জমি নিয়ে। তাদের গ্রামের মোড়ল ঝায়েরা বহু পুরুষ ধরে এই যুগল, বলাইদের মনিব। যুগলের বাবা তারকনাথকে ঝায়েরা কিছু জমি দিয়েছিল বছর তিরিশেক আগে। কিন্তু মহাদেব ঝা মারা যাওয়ার পর তার ছোটো ছেলে রতন ঝা ওই জমিটা ওদের ভুলভাল কাগজে সই করিয়ে ফের নিয়ে নিয়েছে। এই নিয়ে তাদের মধ্যে আর ঝা পরিবারের মধ্যে একটা চাপান-উতোর বেশ কিছুদিন ধরে চলছিলই।
ঘটনাটা যেদিন ঘটে সেদিন বলাই যুগলের সাথে জমি নিয়ে কথা বলতে বিকালবেলায় আসে। রীতা সদ্য কাজ থেকে ফিরেছে। যুগল কাজে যায়নি আজ, ওর শরীরটা ভালো না। জ্বরজ্বর আছে। ওরা দুই ভাই কথা বলছে চৌকিতে বসে, রীতা নীচে কিছুটা দূরে স্টোভে চা বসিয়েছে। খানিক পরেই লতা এসে বসল রীতার পাশে। রীতা লতার কথায় 'হুঁ হাঁ' এর বেশি সাড়া দিচ্ছে না, তার কান তার ভাশুরের দিকে। তার ভাশুর লোক ভালো না। বলাই যুগলের ঘাড়ে কাঁঠাল ভাঙতে চাইছে। তার ভাশুরের ইচ্ছা যুগল মামলা করুক, উনি পিছনে আছেন। কিরকম পিছনে থাকবেন তা রীতার এ ক'মাসে বুঝতে বাকি নেই। রীতার ধারণাটা কিছু মিথ্যাও নয় অবশ্য। বলাইয়ের মনোভাব কিছুটা সেরকমই। বলাইয়ের যা মদের নেশা তাতে টাকা পয়সা জমেনি কিচ্ছু। এখানে একটা পেরেক কারখানায় আজ না হোক বছর বারো কাজ করছে। জমালে জমাতেই পারত। কিন্তু ঘরে সুখ নেই। মালতী বাঁজা। তার উপর বলাইয়ের ওদের কারখানার দারোয়ান মিন্টুর বউয়ের সাথেও একটা সম্পর্ক আছে। সেটা সবাই জানে। এমনকি মালতীও। মিন্টুটাও এক নম্বরের মালখোর বলে কিছু বলে না বলাইকে। বলাই মাসে মাসে কিছু দেয় মিন্টুকে।
রীতার মাথাটা গরম হচ্ছিল ধীরে ধীরে। এই গত শুক্রবারের ঘটনাটা মনে পড়ে যাচ্ছিল। কি মারটাই না মারছিল তার জা'কে মদ গিলে এসে। ভাগ্যে সে গিয়ে পড়েছিল সেই মুহূর্তটাতেই। সে রুখে দাঁড়ায়। তার পাশের বাড়ির লোক বারণ করেছিল, "তুমি ওর মধ্যে ঢুকোনি, ঢুকোনি।" বলাইও শাসিয়েছিল, "তুমি এর মধ্যে ঢুকোনি ছোটো বউ!" ঊঁঃ, রেলা কত! সেও কোমর বেঁধে ভাসুরকে এক ধাক্কা মেরে মালতীকে সরিয়ে এনেছিল। তারপর চীৎকার করে বলেছিল, "দেখো আমিও নারী মানুষ, আর এও নারী মানুষ, খবরদার বলছি, কি অন্যায়টা করেছে ও? আপনি অন্য মেয়েমানুষের সাথে ঢলাঢলি করবেন আর এ মুখ বুজে সহ্য করবে? কেন বলেন তো? ও বাঁজা বলে? তা সে কি ওর দোষ? ভগবান না দিলি কারোর সন্তান হয়? আমি অত নেখাপড়া শিখিনি, কিন্তু এইটুকুন বুদ্ধি মেয়েমানুষ হলিও আছে, যে দোষ ওর নিজের নয়, তার জন্য আপনি কেন ভগবানও ওকে কিছু বলতে পারবেনি বলে রাখলুম।"
রীতার কান্না পাচ্ছিল রাগে। সারাটা গা থর থর করে কাঁপছিল। তার পায়ের কাছে পড়ে মালতীও কি কান্নাই যে কাঁদছিল ঠাকুর। ভগবান যে কেন শুধু পুরুষগুলোকেই বাঁজা করে না!
"ও বৌদি চায়ের জল ফুটে গেল যে?" লতা বলল।
রীতার চমক ভাঙল। ভাঙতেই কানে এলো তার ভাসুর বলছে, "তা হলে ওই কথাই রইল, তুমি উকিলের সাথে কথা বলো, আমি দেখি কি করতে পারি।"
রীতার মাথায় আগুন জ্বলে গেল। সে উঠে দাঁড়িয়ে হনহন করে গিয়ে বলল, "কেন মামলা করবে ও? আমি কতবার তোমায় বলচি, ও মামলার চক্করে পোড়োনি, পোড়োনি, আমরা খেটে খাওয়া মানুষ। অত টাকা কোথায় পাব আমরা? তার চেয়ে পয়সা জমিয়ে এখানেই একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই করলে হয় না?"
বলাই উঠে দাঁড়িয়ে বলল, "যুগল আমি আগেও বলেছি বাড়ির মেয়েমানুষদের এত আস্কারা দিও না... ফল ভালো হয় না..."
যুগল উঠে দাঁড়িয়ে বলল, "তুমি যাও।"
রীতা বলল, "না। যাব না। আমার সংসার আমি নিজের হাতে নষ্ট হতে দেব না। কিছুতেই না। মামলা তুমি করবে না।"
বলাই বলল, "পুরুষদের কথার মধ্যে কথা বলো, কি বেচালা মাগী তুমি!"
ব্যস। যুগলের কি হল, সে ফুটন্ত জলের সসপ্যান ছুঁড়ে রীতাকে মারল। নাকের কাছটা ফেটে গলগল করে রক্ত বেরোতে লাগল। রীতা জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ল।
ঘড়্ ঘড় আওয়াজ শুনে রীতা বুঝল হাসপাতালে এসে গেছে সে। চোখ খুলে যুগলকে খুঁজল। তার বাঁ পাশে সাইকেল হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আচমকা যুগল ঘুরে তাকাতেই রীতা মুখটা ঘুরিয়ে নিল। এত ভয় আর যন্ত্রণা মানুষটার চোখে সে কখনও দেখেনি।
ডাক্তার বেডে শোয়ালো। লতা বলছে, "বৌদি সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে..."
ডাক্তার বললেন, "আমি ওর মুখ থেকে শুনি... আপনার কি হয়েছিল... বলুন, সত্যি সিঁড়ি থেকে পড়ে না..."
রীতা চোখ বন্ধ করল, যুগল কানের কাছে এসে বলল, "তুমি সত্যিটা বলতে পারো। আমি কিছু মনে করব না। একটুও রাগব না।"
রীতা ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল, "কি সত্যি কথা গো? সিঁড়ি থেকে তুমি ধাক্কা মেরেছিলে না আমি মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলাম... যত্তসব!"