Skip to main content

        কিছুক্ষণ জঙ্গলে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে সর্দার ঘুমিয়ে পড়েছে। সর্দার মানে সর্দারজী নয়, ডাকাতের সর্দার। অমনি গাছ থেকে একটা ইয়াব্বড় ডাব মাথায় পড়ে সর্দার অক্কা। বেঘোরে মরলে মানুষ কি হয়? ভূত হয়। তো এই সর্দারও তাই হল। প্রথম প্রথম খুব করে শরীরের নানা গত্ত দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করে দেখল, কিন্তু হল না, পোষালো না। অগত্যা দেহের মায়া ত্যাগ করে খাঁটি ভূত হয়েই জীবনটা কাটিয়ে দেবে ঠিক করল। জীবন? কথাটা কেরকম শোনালো না? জীবন তো জীবের? তবে তার কি হবে? ভূতন?! তাই সই, তা এই এতবড় ভূতনটা সে কাটাবে কি করে? ক'দিন এ গ্রাম, সে গ্রাম ঘুরে বেড়ালো। তারপর কেমন একটা একঘেয়ে ভাব ধরে এলো। খেতে ইচ্ছা করে না, ঘুম বলে কিছু নেই, আর কোনো শারীরিক ক্রিয়াও নেই। তা থাকবেই বা কি করে, শরীরই নেই তা শারীরিক ক্রিয়া!
        সর্দার বসে বসে ভাবতে লাগল সারা জীবন তার কি কি করার শখ ছিল যা সে করে উঠতে পারেনি। মেলা শখ। কিন্তু বেশির ভাগই খাওয়া সংক্রান্ত। সে আর এখন মনে করে কি হবে। সর্দার ভীষণ মুশকিলে পড়ল। এদিকটায় একটাও ভূতও নেই যে প্রাণের কথা খুলে বলে। আর এই বিলিকাটাপুরে লোকে ভূতের ভয়ও পায় না। এই তো সেদিন গ্রামের সব চাইতে বৃদ্ধা, বেশ পয়সাওয়ালা, তাকে ভয় দেখাতে তার সারা রান্নাঘর মাঝরাতে দাপিয়ে বেড়িয়েছিল। কিন্তু সে বুড়ি কি ভয় পাওয়ার পাত্রী? বলল, বিলিকাটাপুরে তো তোদের টিকিটা থাকার জো নেই, তুই কোত্থেকে রে মুখপোড়া? 
সর্দারের কথাটা মানে লাগে। সে বিকট রূপ ধারণ করে বুড়ির সামনে দাঁড়ায়। বুড়ি হ্যারিকেনের আলোটা বাড়িয়ে তার মুখের কাছে এনে বলে, ম্যাগো, নাক টিপলে দুধ বেরোয়, এই সেদিন হওয়া ভূত এলো ক্ষ্যান্তা বামনিকে ভয় দেখাতে? যা যা ওই পিঁড়িটা নিয়ে এসে সামনে বোস, আর শোন্, রামায়ণটা একটু সুর করে পড় দেখি... বিলাপ করেন রাম লক্ষণের আগে...
        সর্দার পড়ল ভীষণ বিপদে, একে সে পড়তে পারে না, তায় রামনামের কথা। সে হুস করে বেরিয়ে পড়ল। আর এদিকে নয়। অনেক ঘুরে, আকাশের এক জায়গায় উঁচু থেকে দেখল কার একটা বিশাল মূর্তি। সর্দার লেখাপড়া করেনি, তাই ঠিক ঠাওরাতে পারল না এটা কার মূর্তি। সে সেই মূর্তির কাঁধে বসে বেশ হাওয়া খেতে লাগল, থুড়ি হাওয়া মাখতে লাগল হাওয়া বপুতে।
        মাঝরাত। আকাশে চাঁদ উঠেছে। হাল্কা চাঁদ। পূর্ণিমা সদ্য গেল। হঠাৎ কে একটা বলল, অ্যাই নাম ঘাড় থেকে! 
        সর্দার থতমত খেয়ে চারদিক তাকাল। কেউ তো নেই। যদ্দূর চোখ যায় নির্জন। হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি খেয়ে মাটিতে পড়ল লুটিয়ে। কি হল বোঝার আগেই দেখে ধুতি-পাঞ্জাবি পরা একটা বেশ শক্তপোক্ত বুড়ো ওই মূর্তিটা থেকে বেরিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে। মূর্তির মুখের সাথে দারুণ মিল এই বুড়োটার। সর্দারের বুক আনন্দে নেচে উঠল, তার মানে ভূত! যাক বাবা বাঁচা গেল! 
        সে এসেই গম্ভীর গলায় বলল, নাম কি?
- সর্দার
- হুম, একই নাম
- কি করা হত?
- ডাকাতি
- কাজটা আলাদা
- আপনার নাম আজ্ঞে?
- সর্দার
- (আপ্লুত হয়ে) আজ্ঞে কোন দলের?
- চুপ করো মূর্খ, ওটা আমার নাম।
- অ, তা কি করতেন, মাষ্টারি?
- রাজনীতি
- তা হলে বললেন যে ডাকাতি করতেন না?
- চুপ করো মূর্খ, এ রাজনীতি সে রাজনীতি নয়, গান্ধীজির নাম শুনেছ?
- হুঁ, টাকা ছাপায় যে
- বুঝেছি, তুমি বরং আমার মাথাটা একটু চাপো।
- ধরেছে বুঝি
- ইদানীং বড্ডবেশি
- আপনার এত বড় মূর্তি (মাথা চাপতে চাপতে)
- হুম
- কেন?
- জানি না
- আপনি নিজে বানিয়েছেন? বেশ, বড়লোক ছিলেন তো তবে?
- আমি বানাইনি, গর্দভ!
- গর্দভে বানিয়েছে? হো হো হো... কি রসিকতা
- চুপ করো, এ মূর্তি আমি বানাইনি
- আপনি খুশী হননি?
- না
- কেন? 
- আসল হৃৎপিণ্ডের জায়গায় নকল হৃৎপিণ্ড দিয়ে শরীর চলে? 
- তা কি হয়? 
- আমি চেয়েছিলাম দেশটা একসাথে থাকবে। জুনাগড়, ভূপাল, হায়দ্রাবাদ... সবাই আলাদা হতে চাইছিল, আমি চেয়েছিলাম সব একসাথে থাকবে... সেই একতাটাই আমার আসল হৃৎপিণ্ড....
        ডাকাত সর্দার চুপ। সে দেখছে অতবড় শরীরের মানুষটার মুখটা যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছে। চোখের মণিদুটো কেমন বিহ্বল। এ সব সে অনুভব করতে পারছে, কিন্তু কেন হচ্ছে বুঝছে না। তার বাবাকে ছোটোবেলায় মাওবাদীরা মেরে ফেলেছিল। তারপর সে তার মায়ের সাথে পালায়। মা নিখোঁজ হয় কিছুদিন পর, তারপর সে কি হতে হতে ডাকাত হয়ে গেছে। না মাওবাদী হল, না রাজনীতি করল। মিছিমিছি ডাকাত হয়ে গেল। 
        ডাকাতের মনটা খারাপ হয়ে গেল। উদাস হয়ে গেল। সে মাথাটা চাপতে চাপতে বলল, আপনার অনুমতি না নিয়ে কাজটা করা ঠিক হয়নি স্যার। 
        মূর্তির সর্দার উদাস হয়ে বলল, হুম। কি জানিস দেশের কেন্দ্রটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। 
দিল্লী বলছেন তো? তা যা বলেছেন, শুনেছি ওখানকার বাতাসে খুব ধোঁয়া। যেই দিল্লী যায় সেই নাকি অস্পষ্ট দেখে। 
        মূর্তির সর্দার বলল, দিল্লী না রে বোকা। বিবেক। মানুষের যেমন একটা বিবেক থাকে, দেশের একটা বিবেক থাকে। রাজা যদি বিবেকের আওয়াজ না শুনতে পায় তখন খাঁটি কাজ করা ভুলে বড় কাজ করতে চায়, বুঝলি? 
        ডাকাতের মনে কি হল কথাটা শুনে। সে ঢিপ করে একটা প্রণাম করে বলল, আমি আর ডাকাতি করব না স্যার দেখে নেবেন আশ্চে জন্মে। 
        মূর্তির সর্দার আবার হাসল। তার মাথায় হাত দিয়ে বলল, তোর ডাকাতি নিয়ে ভাবছি নারে, তুই ছেড়ে দিবি সে তো খুব ভালো কথা, কিন্তু এত এত ডাকাতি, এত এত উঁচু জায়গায় ঠেকাবে কে? 
        ডাকাত চুপ। সে ডাকাতি করার কথাই ভেবেছে, থামানোর কথা তো ভাবেনি কস্মিনকালেও। সে বলল, বিবেকটা সুস্থ হয় কিসে আবার?
        মূর্তির সর্দার বলল, লোভ গেলে। কিন্তু সেকি আর যাবার জিনিস। সে তো ঘুণপোকা। 
        দুই সর্দার চুপ। মূর্তিটা ভয়ংকর দেখাচ্ছে, যেন এতবড় আকাশটাকে গিলে খেতে আসছে। মূর্তির সর্দার গুণগুণ করে গান গাইছে। সুরটা ডাকাতের সর্দার চেনে, ডাকাতের আরেকটা শখ গান শোনা। এ গানটা সে জানে, কোনো একটা সিনেমায় শুনেছিল... বৈষ্ণব জন কো, তেনে কহিয়ে জি... পীড় পরাই জানে রে...
সেও সাথে সাথে গাইতে শুরু করল। সর্দার গান থামিয়ে বলল, তুই যাকে টাকা ছাপানোর মালিক বললি, সেই চাইত মানুষের টাকার লোভটা যেন কমে, মানুষ যেন নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ না হারায়, তাকেই স্বাধীনতা বলে, বুঝলি? 
        ডাকাতের সর্দার বলল, বুঝলাম না, তবে আপনার কথাগুলো খুব মিষ্টি। আপনার সাথেই থাকলাম। আসুন মাথা টিপে দিই। ডাকাত মাথা টিপে দিতে দিতে শুনতে পেল, তার আশেপাশে আরো কতজন বসে গানটা গাইছে। আরেকটু দূরে একটা আলোর মত শরীর। ডাকাত ফিসফিস করে সর্দারের কানে জিজ্ঞাসা করল, ওটা কে?
সর্দার বলল, তোর টাকা ছাপানোর মালিক, সবুর কর চোখটা স্পষ্ট হলেই দেখতে পাবি।