সকাল থেকে নাওয়া খাওয়া নেই থরহরিবাবুর। কলের লাইনের উপর নারকেল গাছ পড়ে লাইন ফেটে গেছে। পুজো চলছে, সকাল থেকে সাত-আটজন কলের মিস্ত্রীকে ফোন করা হয়ে গেছে। কেউ আসবে না। এমনকি ডাবল টাকা দিলেও না।
স্নান করবেন কোথায়? এইটাই হয়েছে মূল সমস্যা। প্রাকৃতিক ক্রিয়াদি সকালেই হয়ে গেছে। কিন্তু স্নান? সামনেই পুকুর, নেবে গেলেই হয়। কিন্তু সেই কপাল কি আর করেছেন? চারদিন ধরে বলে যাচ্ছে গভীর নিম্নচাপ তৈরি হয়েছে। আর সে নাকি আজকেই আসছে। এইবার? আজ সকালেই খবরে দেখালো মৎসজীবীদের নৌকা নিয়ে সমুদ্রে যেতে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। তা অতবড় সমুদ্রে যদি ঝড়ে এত নিয়ম হয়, পুকুরে হবে না? একটা ঘূর্ণি উঠতে কতক্ষণ? তারপর দেখা গেল সেই ঘূর্ণি এত প্রবল হল যে মাটির নীচে স্ক্রুয়ের মত ঘুরিয়ে ঢুকিয়ে দিল। কিম্বা চারতলা সমান ঢেউ উঠে হয়তো কারোর বাড়ির ছাদেই নিয়ে গিয়ে ফেলল। তখন? না রে বাবা! কিন্তু স্নান না করলে তো পেটগরম হবে! আজ আবার খাসি হয়েছে বাড়িতে। ওতে তো আরো পেট গরম হয়! তবে?
এগারোটা বাজল। আকাশ জুড়ে কালো মেঘ করে এসেছে। বাড়ির সবাই একে একে গিয়ে স্নান করে চলে এল। তাকে স্নানে যেতে বললেই তিনি "এই তো যাচ্ছি" বলে খাটের আরো ভিতরে সেঁধিয়ে যাচ্ছেন। সামনে টিভিতে আসন্ন ঝড়ের কথা বলছে। কি হবে?
শেষরক্ষা হল না। ছোটো মেয়ে জামাই নিয়ে চলে এল। জামাই শ্বশুর না খেলে খাবে না। এদিকে সে এখনই মেয়েকে রেখে চলে যাবে, দোকান খুলে এসেছে। অগত্যা কাঁধে গামছা নিয়ে ঠাকুর ঘরের দিকে এগোলেন। বউ বলল, আরে পুকুরটা ওদিকে না, এদিকে।
শুকনো গলায় থরহরিবাবু বললেন, আসলে সকাল থেকে প্রণাম করা হয়নি কিনা....
বউ গজগজ করতে করতে চলে গেল। ভীমরতি - শব্দটা খালি কানে এল। ঠাকুরঘরে ঢুকলেন। মাথা নীচু করে মাটিতে ঠেকিয়ে প্রণাম করলেন। চোখের কোলে জল চলে এলো। বাইরে হাওয়ার বেগ বাড়ছে শুনতে পাচ্ছেন। হঠাৎ ধড়াম করে ঠাকুরঘরের একটা জানলা পড়ল। চমকে উঠলেন থরহরিবাবু, মনটা কু ডাকল।
চলুন বাবা, স্নানটা সেরে আসি।
ছোটো জামাই, পরিতোষ, কাঁধে টাওয়েল ফেলে দাঁড়িয়ে। খালি গা, লুঙ্গি পরনে।
মৃদু হাসির রেখা দেখা দিল থরহরিবাবুর ঠোঁটের কোণায়, সবই বিধির খেলা। আজ তাকে নিয়েই ছাড়বে। নিয়তি... সবই নিয়তি। মনে মনে মাধবীলতার বৈধব্যের বেশ কল্পনা করে ফেললেন। ঝড়ের বেগ বাড়ছে। সামনে জামাই, পিছনে শ্বশুর চলেছে পুকুরের দিকে।
পুকুরে জলের উপর গোলগোল ঢেউ। নারকেল গাছের ছায়াগুলো তুমুল দুলছে। পুকুরঘাটে কেউ নেই। হঠাৎ বাজ পড়ল কোথাও ধারেকাছে। চমকে উঠে বসে পড়লেন রাস্তায় থরহরিবাবু। জামাই খেয়াল করেনি, সে কিছুটা এগিয়ে বাঁশবনের আড়ালে চলে গেছে। ধুমপান করবে। বুকটা ধড়াস ধড়াস করছে থরহরিবাবুর। একটু বসে আবার উঠে দাঁড়াতে যাবেন, আবার বাজ পড়ল। এবারেরটা আরো জোরে। পাশের আমগাছটা জড়িয়ে ধরলেন। মা বাঁচা আমায়! রক্ষা কর মা। রক্ষা কর!
বাবা আসুন.... পুকুরে কি ঢেউ দেখে যান.. যেন পুরীর সমুদ্র....
পরিতোষের গলা। বিধির ডাক। নিয়তির ষড়যন্ত্র। কে বাঁচাবে? নইলে পুকুর সমুদ্র হয়ে ওঠে! হা হরি! যে পুকুরে ছোটোবেলায় সাঁতার শিখলাম সেই পুকুরই আজ আমার মৃত্যুর কারণ হতে চলেছে! পুকুর, ওহে পুষ্করিণী, তোমার কি পাষাণ হৃদয়! এক শিশুকে কোলেপিঠে করে মানুষ করে তাকেই আজ বধ করবি নিজের বুকে! কি পাষাণী তুই..
পরিতোষ গলা জলে দাঁড়িয়ে। তাকে বেড় দিয়ে দিয়ে কালনাগিনীর মত ঢেউ! এইকি পুকুর! ওই তো তার পূর্বপুরুষেরা সার দিয়ে ওপারে দাঁড়িয়ে। এ পুকুর নয়, ওহে তুমি নহ পুষ্করিণী, তুমি বিধাতা রচিত চক্রব্যূহ। হায় মাধবীলতা, হায়, ওই খাসি তোমার আজ আর খাওয়া হল না। কতদিন বাদে তোমার অর্শের যন্ত্রণা কমেছিল বলে আজ এনেছিলাম। কিন্তু কপাল!
এক পা, এক পা করে নামছেন থরহরিবাবু। বুকটা ধড়াস ধড়াস করছে। সামনে প্রবল ঢেউ। ঢেউয়ের পরে ঢেউ। কি উঁচু। পা'টা কাঁপছে। একি! একি! পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে কেন? তিনি কি ডুবে যাচ্ছেন? ওই তো চারদিকে গাছপালাগুলো পাগলের মত মাতামাতি করছে। আলিপুর আবহাওয়া দপ্তরে বাতাসের বেগ কত? সব মাঝিদের আজ সমুদ্রে যাওয়া বারণ। সমুদ্রে ঝড় উঠে গেছে। মাস্তুল ভেঙে পড়ছে। জাহাজের ডেকে জল উঠে পড়ছে। বুকে চাপচাপ লাগছে। মুখে নোনতা জল ঢুকছে। পায়ের তলায় বালি আর বালি। চারদিকে ঘুর্ণি। ঘুর্ণির মধ্যে কে ও? ওই তো কালিয়ানাগের উপর নাচছেন কৃষ্ণ। আহা! ওই তো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন। পাশে কে নাচছে, পরিতোষ, তার পাশে কে ওটা? ও তো মাধবীলতা, কিন্তু কার হাত ধরে নাচছে? আরে এতো সেই খাসিটা... লছমনের খাসি....
চোখ মেলে তাকালেন। চারদিকে ভিড়। মাধবীলতা ছলছল চোখে তাকিয়ে। থরহরিবাবু চোখ মেলতেই কাঁসর-ঘন্টা বেজে উঠল। শাঁখ বাজালো কেউ কেউ। কি হচ্ছে বুঝতে পারছেন না থরহরিবাবু। পাড়ার বহুলোকে এসে তাকে প্রণাম করে যাচ্ছে। কি হল? সবাই এমন ব্যবহার কেন করছে?
খানিক বাদে সবটা স্পষ্ট হল। থরহরিবাবু অজ্ঞান হয়ে পুকুরে ডুবে যাচ্ছিলেন। পরিতোষ আর পাড়ার কয়েকটা ছেলে তখন স্নান করছিল। তারা তাড়াতাড়ি এসে জল থেকে তুলে যখন পাড়ে নিয়ে এসে রাখল, তখনও থরহরিবাবু অজ্ঞান। কিন্তু হাতে ধরা একি!
আহা! থরহরিবাবুর ঠাকুমা, একশো বারো বছর হল এই আষাঢ়ে, তিনি চিনতে পারলেন, এ যে তাদের বংশের নারায়ণশিলা! চিন্তামণিদেবী, মানে থরহরিবাবুর স্বামী ছিলেন কট্টর বামপন্থী, ঠাকুর-দেবতা মানতেন না। একবার লটারিতে হেরে গিয়েছিলেন বলে টান মেরে নারায়াণশিলা এই পুকুরে ফেলে দেন। সেই থেকে নারায়ণ এই জলে। আজ থরহরিকে অজ্ঞান করে তিনি আবার বংশে সুপ্রতিষ্ঠিত হলেন। এই হল গল্প।
থরহরিবাবুর যদিও এসবে কিছু ভাবের পরিবর্তন হল না, কিন্তু তিনি সম্পূর্ণ নিরামিষাশী হলেন। মাধবীলতার সাথে খাসিটার নাচের দৃশ্য তিনি মাঝে মাঝেই রাতে স্বপ্ন দেখেন, আর চমকে চমকে ওঠেন।
[ছবি Suman]