সৌরভ ভট্টাচার্য
6 July 2020
সংসারী
---------
গুরু বসে আছেন চেয়ারে সোজা হয়ে। ভক্ত দাঁড়িয়ে, হাত জোড় করে। শরীরটা মাঝে মাঝেই কেঁপে উঠছে, ঠাণ্ডায়। বাইরে জুলাই মাসের গরম। গুরুগৃহ শীতল। চারটে এসি লাগানো চারদিকে। মনে মনে ভক্ত ভাবছেন, একটা চাদর নিয়ে এলে হত। ঠাণ্ডা লেগে যাবে না তো? এখান থেকে বাইরে বেরোলেই প্রচণ্ড রোদ। আবার প্রসাদের লাইনে দাঁড়ানো। প্রায় দেড় ঘন্টা লাইনে দাঁড়ানোর পর গুরুগৃহে প্রবেশ করেছেন। আবার প্রসাদের লাইন আছে। তারপর বাসের ভিড়। তারপর ট্রেনের ভিড়। সেটুকু তো করতেই হবে, নইলে মনের শুদ্ধি হবে কি করে? কিন্তু মনে অনেক প্রশ্ন। উত্তর জানা নেই। সব উত্তর কি আর বইতে আছে? কিন্তু সবাই ভীষণ ব্যস্ত। চিঠি লিখলেও হয়, কিন্তু মনের কথা অমন করে গুছিয়ে লেখার ক্ষমতা নেই যে। সামনা সামনি কথা বলার সাধই আলাদা।
গুরু উপায় কি?
ত্যাগ...
ভক্ত চারদিকে চোখ বোলালেন। চারিদিকে যা সামগ্রী তার অর্ধেকও তার নিজের ঘরে নেই। আরো ত্যাগ করতে হবে?
কাম আর কাঞ্চন...
কাম ত্যাগ তো হবে না... দুটো ছেলে... কাম ত্যাগ করে ছেলেপুলে হয় কি? আর কাঞ্চন এনারাই ত্যাগ করতে পারছেন না... এত সাধনা করে... আমি দিনে বড় জোর একঘন্টা জপ করে ত্যাগ করতে পারব কি?...
প্রচণ্ড রোদে বাইরে এসে ভক্ত প্রসাদের লাইনে দাঁড়ালেন। মনের মধ্যে হাজার একটা প্রশ্ন। সাথে ক্লান্তি। দুপুরে অন্নপ্রসাদের পর ঝিমুনি লাগতে শুরু করল। বাসে ঝিমোলেন। ভিড়ের মধ্যে। ট্রেনে ঝিমোলেন। ভিড়ের মধ্যে। বাড়ি ফিরে ঘুম। সন্ধ্যেবেলা ঘুম ভাঙল। স্ত্রী এলেন চা নিয়ে। মনে দ্বিধা এলো – কামিনী? ত্যাগ? চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে সামনে ঝোলানো গুরুদেব, ইষ্টদেবের ছবির দিকে তাকিয়ে রইলেন। উপায়? আবার ঘুম পাচ্ছে। শরীরে ভীষন ক্লান্তি। প্রচণ্ড গরম। গুরুগৃহের শীতলতা মনকে আচ্ছন্ন করে থাকল। কোনটা বেশি শীতল? এসি, না ব্রহ্মজ্ঞান? মন বলল, আপাতত এসি... এসি... এসি...
গুরুর কথা মনে পড়ছে। একটা দামী গাড়ি এসে দাঁড়ালো গুরুগৃহের সামনে। গুরু সবাইকে হাত নাড়তে নাড়তে উঠলেন। সামনে তিনশো মিটার দূরে মন্দিরে প্রণাম করতে যাবেন।
পা’দুটো টনটন করছে। গীতার কথা মনে পড়ছে – শীতোষ্ণোসুখদুখেষু সম – শীত উষ্ণ সুখ দুঃখ সমান দেখার কথা আছে। সে কাকে বলেছেন? গীতার টীকাটা পড়তে ইচ্ছা করছে। কিন্তু পাশের ঘরে যেতে ইচ্ছা করছে না। একটা গাড়ি মনকে গীতার কাছে নিয়ে যেতে পারত। সংসারে সম্পদ মানুষকে ঈশ্বরের কাছে বেশি নিয়ে যায়, না অভাব?
মানুষটা ঘুমিয়ে পড়ল। গৃহিনী এসে আলো নিভিয়ে দিয়ে গেল। অন্ধকার ঘর। শান্তিতে ঘুমাক। শান্তি কিসে, অন্ধকারে না আলোয়?
দেবদাসী
----------
মেয়েটা বিয়ের ক’টা বছর বরের সাথে ঘর করল? বর একদিন নিরুদ্দেশ হল। লোকে বলল, কার সাথে যেন নিরুদ্দেশ হল। মেয়েটা চিনতে পারল সে কার সাথে পালালো। মেয়েটা পাগলের মত হল। সারাটা দিন কি করবে ভেবে পায় না। সবাই বলল, মন শান্ত করো। সবাই বলল, মেয়েমানুষ অত উতলা হলে হয়? কিন্তু কেউ একবারের জন্যেও বলল না, সেই মানুষটাকে আনার ব্যবস্থা করা হোক। তার নামে নালিশ জানানো হোক। মেয়েটা বুঝল, সংসারের সবটুকু সে বোঝেনি। বুঝেছেন গুরু। তিনি বললেন, মনটা শান্ত করো। এই নাও শাস্ত্র। শাস্ত্র মানে যা মনকে শাসন করে। তুমি এমন সুলক্ষণা। এসো, সাধনার পথে এসো।
মেয়েটার মন একটা খুঁটি পেল। কারণ আত্মহত্যা করতে তার সাহস হচ্ছিল না। তাই মনে মনে ভাবল, একটা অজানা অন্ধকারে যখন ঝাঁপ দিতেই হবে তখন এই দিকেই ঝাঁপ দিই। আসলে মেয়েটা বুঝল না, আলোহীন অন্ধকার যেমন মানুষকে হারিয়ে ফেলে, তেমনই প্রয়োজনের অতিরিক্ত আলো, অসহ্য আলো চোখকে ধাঁধিয়ে দিয়ে বিভ্রান্ত করে। মেয়েটা ভাবল, এই বিভ্রান্তিই বুঝি বা পথ। যাকে স্পষ্ট করে জেনেছিল, পেয়েছিল, সেই মানুষটাই যখন এমন অজানা অধরা রয়ে গেল, তখন আর বাকি কিছুতে কি বা এলো গেল?
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শোকের আয়ু মানুষের আয়ুর চাইতে কম হয়। তাই মেয়েটা সেদিন বুঝতে পারেনি যে, যে শোকের আগুনকে মশাল করে সে এগোচ্ছে, সে আগুন একদিন নিভবে। অথচ তার চলা শেষ হবে না।
মেয়েটা একদিন দেখল সে শান্ত হয়ে গেছে। কালের নিয়মেই হয়েছে। সবটুকু মেনে নিয়েছে। কিন্তু কেউ তাকে কেন সেদিন বলল না, তুমি তোমার মত করে তোমার জীবনটাকে দেখো, ভালোবাসো, মূলস্রোতে এসো ফিরে। তোমার সে পলাতক ভালোবাসা আর ফিরবে না, সে কাপুরুষ। এ সব কেউ বলল না তাকে। কেন তাকে এরকম একটা ভয়ানক খেলায় মাতিয়ে দিল সবাই? সবাই তার দিকে তাকিয়ে বলে, "অমুকের বউটাকে দেখেছিস, এখন ঠাকুর ছাড়া আর কিছুই জানে না সে। কি লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে গো! ভালোই হয়েছে, সংসারে কি আছে? শুধুই ধোঁকা। শুধুই মিথ্যা। ওর স্বামীটা মেয়েটার দেবীত্ব বুঝলই না। একদিন এর শাস্তি সে পাবেই। কিন্তু সেদিন এই মেয়ে মায়ার সংসারের মোহ কাটিয়ে ঈশ্বরের আনন্দে ভরপুর হবে। ওর চোখ দেখেছেন? ওর চালচলন দেখেছেন? ওর কথাবার্তা দেখেছেন? ওর ধ্যানে বসে থাকা মূর্তি দেখেছেন? ওর নামগানে চোখে জল আসা দেখেছেন?"
মেয়েটার অসহ্য লাগে এসব শুনতে শুনতে। যদি এমন ভালো পথেই সে হাঁটছে, এই যদি সবার জীবনের কাম্য হয়ে থাকে তবে তারা সবাই এ রাস্তায় হাঁটে না কেন? কেন সবাই নিজেদের মত সংসার করছে? কেন সব ছেড়ে বেরিয়ে আসছে না তারা? তারা বলে, তাদের নাকি সময় হয়নি। আশ্চর্য লাগে তার। কি করে বুঝল তারা তার একারই সময় হয়েছে?সেকি তাদের অধ্যাত্ম আমোদের বস্তু? সে কি চায় না চায় কেউ কেন বোঝে না? কেউ বুঝতে চায় না? সবাই বলে, সে নাকি কোন উচ্চাসনে বসে আছে! সেখানে তার দম আটকে আসে যে! কান্না তার নামগানে পায়, সে তৃপ্তিতে না, অভাবের যন্ত্রণায়, ভিক্ষার আশায়, একটু সুখের কাঙালপনায়। কেন তারা সবাই তার জীবনের উপর তুলি বুলিয়ে নিজেদের মত রঙ করতে চায়? যেন সে একটা সাদা পাতা!
মেয়েটা ক্রমে বয়স্ক হয়ে উঠল। চামড়া কুঁচকে গেল, চোখে বাইফোকাল চশমা এলো। কিন্ত সে এ সব ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারল না। সবার যে একটা পরিচয় লাগে বাঁচতে। তার এ পরিচয় যতই ফাঁকি হোক, এখন একটা অভ্যাস হয়ে গেছে - শান্ত থাকার ভান করা, সব সময় হাসিমুখে, মিষ্টিস্বরে কথা বলা, রাগ হলে শাস্ত্রের দোহাইয়ে যাকে তাকে অপদস্থ করা, এবং অবশ্যই কখনো সংসারিদের ভাষায় আক্রমণ না করা। তার জীবন এখন ঈশ্বরের জ্বলন্ত উপস্থিতির প্রমাণ। এইটা ভাবলে ক্রুর একটা আনন্দ হয় তার এখন। ঈশ্বরের অস্তিত্ব এখন যেন তার আচরণের উপর নির্ভর করছে। সে যত ভালো অভিনয় করবে তত মানুষ ঈশ্বরের উপর ভরসা রাখবে। অন্যথা হলে ঈশ্বরের বিপদ। কিন্তু এ মোহ ছাপিয়ে আবার বুকে হাহাকার ওঠে। ডাক্তার বলে, মাইগ্রেণ। সমাজ বলে, না, সাধনার তাপ। গুরু মুখে বলে, বৈরাগ্যের আগুন। কিন্তু গুরুর চোখ খোঁজে সে কিসের যেন আগুন।
আজকাল মাঝে মাঝে গুরু এসে থাকে তার সাথে। সমাজ নিন্দা করে না। গোপন সন্দেহ করে। হরমোন না ঈশ্বর - কে বেশি শক্তিশালী? বুদ্ধি আর হৃদয়ের সেই প্রাচীন দ্বন্দ্ব শুরু হয়। সেই দ্বন্দ্ব কাটাতে মন্দিরে, মন্ত্রে, নানা উপচারে, অনুষ্ঠানে, শাসনে, নিয়মে, গুরুতে - ঈশ্বরকে যতই স্থূল ধরাছোঁয়ার মধ্যে আনার চেষ্টা করা হয়, ততই তিনি এ সব ছাপিয়ে উড়ে উড়ে চলে যান। মেয়েটা তল পায় না। না ঈশ্বরের, না নিজের, না সমাজের। চারদিকে শুধু একটা নিয়ম। একটা অভ্যাসই যেন জীবন।
গুরু শেষ জীবনে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছিলেন। যে সমাজ পুরুষ হয়ে বাড়ির পিছনের দরজায় দ্বিধান্বিত প্রবেশাধিকার চায়, সেই সমাজই কি নির্লজ্জের মত সব নারীকে মাতৃরূপে সাজিয়ে, সেই মহত্বের মোড়কে নিজের অসহায়তার প্রশ্রয় চায় দেখে তার করুণা হয় এখন।
গুরু তাকে গভীর শান্তি দিয়েছে জীবনে। সমস্ত জীবনটাকে মাধুর্যে ভরে দিয়েছে। শাস্ত্রের সব কথা সত্যি, মানুষের জীবনে ঈশ্বরলাভ না হল তো কি হল? - এখন নিজেকে এই সব বিশ্বাসে ঢেলে সাজিয়েছে সে। তার সাধ্বীজীবনকে সে শাড়ির আঁচলের মত মেলে ধরে সবার সামনে। সংসারের তাপে পোড়া মানুষের মনে ক্ষোভ তৈরি করে শান্তির জল ঢেলে দেয়। বলে সবটাই প্রারব্ধ। আবার একটা ক্রুর আনন্দও পায়। প্রতিশোধ নিতে চায়। কিন্তু নেয় না। যত্নে সাজানো মধুর ফাঁকির চেয়ে সত্য সংসারে আর কিছুর অভিজ্ঞতা হল না যে তার। সবটুকুই কি তার দোষেই হল?
পাঠক বলবেন, তারপর কি হল? সত্যি করে বলুন তো, এই গল্পের শেষ জানতে কি সত্যিই আপনারা আগ্রহী? এই গল্পগুলোর শেষ হয় কোনো কুৎসায়, নয় একান্ত উদাসীনতায়। দেবদাসীবৃত্তিটা হয়তো উঠে গেছে, কিন্তু সেটা বানানোর প্রবৃত্তিটা আমাদের এখনও যে যায়নি, এমন উদাহরণ আমি আজও কম দেখি না, আমাদের অধ্যাত্ম আমোদের নেশায়।