যে ফুলগুলো মালা গাঁথায় কাজে লাগে না, হাটে বিক্রি হয় না, খুঁত থাকে বলে, সেগুলো দিয়ে সে নিজেকে সাজায়। তার দিকে কেউ তাকায় না। তার ফুলের দিকেও তাকায় না।
শিবরাত্রির দিন সন্ধ্যেবেলা হঠাৎ শিব এসে কড়া নাড়ল তার ঘরে। দরজা খুলতেই বলল, তোমার কাছে ফেলে দেওয়া ফুল আছে? যেগুলো দিয়ে তুমি সাজো!
আসলে তো সে শিব নয়, সং সেজে এসেছে। তার পিছনে দাঁড়িয়ে পার্বতী। একটা ছেঁড়া নোংরা নাইটির উপর কতগুলো নকল সস্তা গয়না পরেছে। মাথায় চেলি। রুগ্ন মুখটায় এত রঙ মেখেছে মনে হচ্ছে যেন পুকুরপাড়ের সিঁড়িটা, সাবান লেগে লেগে যেমন হয়েছে সেটা, তেমন। পার্বতীর দাড়িগোঁফ কামানো মুখে নথ, কাজল, সিঁদুর দেখতে দেখতে ফুলওয়ালী বলল, তা আছে কিছু ফুল। পয়সা লাগবে। পাঁচ টাকা।
শিব বলল, দু'টাকায় দে না মা।
যেন শিব এসেছে ভিক্ষা চাইতে, অন্নপূর্ণার দ্বারে। পার্বতী বলল, দে না বোন, তুই সেজে যাস, কি যে ভালো লাগে।
ফুলওয়ালী বলল, তোমার চোখে পড়ে?
পার্বতী বলল, বছরে এই একটা দিনই তো মেয়ে সেজে সাধ মিটিয়ে নিই রে, বাকি দিনগুলো তো শুধু হিংসা হিংসা…. তোদের শরীরকে…. আমার তো গোটা জীবন পুরুষের শরীরে সং সেজেই কাটল….
পার্বতী ফুলওয়ালীর বুকের দিকে তাকিয়ে। ফুলওয়ালী বলল, যাহ! নাও ফুল, দিতে হবে না পয়সা!
মহাদেব ভিক্ষাপাত্রে ফুলগুলো নিল। তার জং ধরা ত্রিশূল ফুলওয়ালীর মাথায় ঠেকিয়ে বলল, মহাদেবের কাছে প্রার্থনা করি, তুই সুখী হ।
ফুলওয়ালীর চোখে জল এলো। বলল, তোমরাও হও। চোখের জল বড় ছোঁয়াচে। পার্বতী বলল, এই মেয়ে কাঁদাবি না, আমার মেকাপ উঠে যাবে, আবার রতনদা পঞ্চাশ টাকা নেবে। আসি….
শিবপার্বতী অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। ফুলওয়ালী দেখল সত্যি সত্যিই শিব-পার্বতী। তার হেলাফেলার মালার ফুল নিয়ে গেল। চোখে তো পড়েছে তাদের তাকে! এই বা কম কি! এইটুকুই তো চায় মানুষ, তাকে একটু চোখে পড়ুক কারো। তার ভালোবাসা, ব্যথা, সুখ। সে সব কিছু না চোখে পড়লে শরীর এগিয়ে দেয় মানুষ। সং সাজে। কিন্তু সং এর আড়ালে তো একটা সত্যি মানুষ তো থাকেই!
ফুলওয়ালী ঘরে এসে বসল। আজ তার খুব বুক হাল্কা করা কান্না পাচ্ছে। যেন পুজো নিতে এসেছেন প্রভু নিজে, তার বুকের দরজায়। ডাকছেন তাকে, ফুলওয়ালী দরজা খোলো.. এ গোটা সংসারটা সং, এর পিছনে আমিও আছি… সত্যিই সত্যিই… একবার ডেকে দেখো না….. এই তো আমি….