Skip to main content

সন্ধ্যেবেলা হেঁটে ফিরে এসে দেখি কি সমস্যা, বাড়ির এক্কেবারে বাইরের দরজার গ্রীলের ফাঁকে আটকে একটা বাচ্চা কুকুর। আপ্রাণ বেরোতে চেষ্টা করছে, ডাকছে। বেরোতে পারছে না। পাড়ার কুকুর। গেট খোলা থাকলেই বাগানে ঢুকে পড়ে। তারপর বেরোবার সময় এই রকম ফাঁকে আটকিয়ে কিছুক্ষণ খণ্ডযুদ্ধ করে নিজের থেকেই মুক্ত করে নিজেকে।
এবারটায় হল না। এক ঘন্টা পার হল। কিছুতেই বেরোতে পারছে না। এ'কদিনে তার চেহারাটা যে খানিকটা হলেও বেড়েছে, সে বোধ ব্যাটার হয়নি। দেহের সামনের দিকের প্রায় বহু অংশটাই বাইরে। পিছনের পা কোমরশুদ্ধ আটকে। বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টা করা গেল। ঠেলাঠেলি। বিস্কুট দিয়ে অন্যমনস্ক করে গুঁতিয়ে বার করার চেষ্টা - সব ব্যর্থ।
ঠিক হল গ্রীল কাটা হবে। এদিকে রাত প্রায় ন'টা বাজতে চলল। গ্রীল কাটার লোকের নাম্বার জোগাড় তো করা হল, কিন্তু এত রাতে পাব কি তাকে? হঠাৎ খেয়াল এলো, আমাদের এক বন্ধুর কথা, তার বাড়িতে নানারকম কুকুর। অসম্ভব ভালোবাসে কুকুর। তাকেই ফোন করা হল। সে শুনেই বলল, আসছি, দশ মিনিট দাঁড়াও।
ঠিক তাই এল। নিজের অত্যন্ত জরুরী কাজ ফেলে। হাঁটু গেড়ে কুকুরটার সামনে বসল, তার মাথায় হাত রাখল। ধীরে ধীরে তার পিছনের পা দুটো টানতে লাগল, আর একজনকে বলল, সামনের পাদুটোকে সামনের দিকে উঁচু করে ধরে থাকতে। অভয় দিল, কামড়াবে না। কুকুরটা বেরিয়ে এল।
বেরিয়ে এসেই বসে পড়ল। পিছনের পা নিয়ে এত ধ্বস্তাধস্তি হয়েছে যে দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই। কেটেও গেছে খানিকটা। উক্ত বন্ধু তার কাটা জায়গায় মলম লাগালো, এমনভাবে মিলিয়ে দিল মলমের অবশিষ্টাংশও যেন কিছু না লেগে থাকে তার গায়ে। চেটে ফেলবে না! তারপর বলল, প্যারাসিটামল আছে? আছে তো। ওকে খাওয়াতে হবে, এত ধস্তাধস্তিতে গায়ে ব্যাথা হবে যে! দিলাম। অদ্ভুত কৌশলে খাইয়ে দিল। খানিক বাদে কুকুরটা হেঁটে ফিরে গেল। বন্ধু আমায় যাওয়ার আগে বলল, তুমি চিন্তা কোরো না, এ ব্যাটা কালই দৌড়াবে। সে ফিরে গেল তার অসম্পূর্ণ কাজ পুরো করতে।
আমরা পারলাম না কুকুরটাকে বার করতে, কারণ সে আমাদের কাছে একটা পশু ছিল, যে অসাবধান হলে কামড়াতেও পারে। আমাদের বন্ধুটার কাছে সে পশুর চাইতে অনেক বেশি। কারণ সেই আদি অকৃত্রিম সমস্ত কুয়াশা, অজ্ঞানতাভেদী আলো - ভালোবাসা। না হলে আমি হাজারবার জন্মালেও কুকুরটাকে প্যারাসিটামল খাওয়ানোর কথা ভাবতে পারতাম না। তারও যে একটা শরীর আছে, তারও যে ব্যাথা লাগে, এ কথা জ্ঞানে থাকলেও বোধে ছিল না তো। কি করে থাকবে, আমি তো ভালোই বাসতে সক্ষম ছিলাম না!
আজ সকালে যখন কুকুরটার দিকে দেখলাম, দেখলাম তাকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেছে এক রাতেই।
এই হয়। বারবার ভুলি। তবু এটাই সত্যি, একমাত্র ভালোবাসতে পারলেই আমি সঠিকটা জানতে পারি। না তো উপেক্ষায়, না তো মোহে আমি সঠিকটা জানতে পারি। জানলেও বোঝাতে পারি না। যা অন্তর্জীবনের জ্ঞান, তার একমাত্র পথ ভালোবাসাই। তাই শতযোজন দূরে থেকেও কেউ আমারই মধ্যে বাস করে, আর কেউ পাশের বাড়িতে থেকেও আমার থেকে লক্ষযোজন দূরত্বে থাকে। সমস্ত রহস্য, সব জটিল অঙ্ক এই একটা সূত্রেই সমাধা হয়ে আসছে চিরটাকাল। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, যদি মাকে শেখাতে হয় কি কি ভাবে শিশুর খেয়াল রাখতে হয়, তবে লিস্টের শেষ হয় না। কিন্তু যেই তার মধ্যে শিশুটার প্রতি প্রেম জন্মালো, সে সব বুঝতে পারল। কোনটা পেট ব্যাথার কান্না, কোনটা খিদের কান্না। সেই হল কথা।
ঠাকুর তাই একটাই উপায় বললেন, ভালোবাসো। যাকে দেখিনি তাকে ভালোবাসব কি করে? এর উত্তর কথায় দিতে পারি না। যাদের ভালোবাসি তাদেরকে কি শুধু দেখেছি বলেই ভালোবাসি? মন এ কথায় সায় দেয় না। দেখেছি তো বটেই, তবে সে কোন চোখে?