মন্দিরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আবার আর্তনাদটা শুনল। একই আওয়াজ। সময়টাও একই, সাড়ে সাতটা বেজে কয়েক সেকেণ্ড। দাঁড়িয়ে পড়ল ভবেশ। পিছিয়ে এল কয়েক পা। মন্দিরের বন্ধ দরজাটার দিকে তাকালো। কিছুক্ষণ আগেই বেশ বৃষ্টি হয়ে গেছে। মাটিটা ভিজে। পা দেবে আছে মাটির মধ্যে। মন্দির থেকে সাত-আট পা দূরে একটা ডুমলাইট জ্বলছে। গ্রামে রাস্তার আলো বলতে এই হলুদ হলুদ ডুমলাইট কয়েকটা। প্রায়ই কেটে যায়। অনেকটা রাস্তা অন্ধকারেই হেঁটে যেতে হয়। নতুন কারোর পক্ষে অক্ষত হেঁটে যাওয়া খুব মুশকিল। ভবেশের রাস্তাঘাট, গর্ত, কোথায় কি গাছ --- সব মুখস্থ। বত্রিশের কাছাকাছি বয়েস, গ্রামের বাইরে আর গেল কোথায় ভবেশ?
কেউ কোত্থাও নেই! চটিটা খুলে মন্দিরের চাতালে উঠল। এটা শিব মন্দির একটা। আগে বলা হত জমিদার বাড়ির মন্দির। এখন শুধুই চাটুজ্জ্যেদের শিব মন্দির বলা হয়। পরিতোষবাবু পুজো দিয়ে সন্ধ্যে সন্ধ্যে মন্দির বন্ধ করে চলে যান। কিছুটা দূরেই শ্মশান বলে এই দিকটায় কেউ আসে না। চার-পাঁচটা গ্রাম মিলে এই একটাই শ্মশান। মড়া পুড়তে থাকলে এই মন্দির থেকেই আগুন দেখা যায়, গন্ধ পাওয়া যায়। পোড়া মানুষের গন্ধ ভবেশ সেই ছোটোবেলা থেকেই পেয়ে আসছে। ভয়ডর বলতে তেমন কিছু একটা ছিল না কোনোদিন ভবেশের। তারপর কলেজে পড়তে গিয়ে বিজ্ঞানসভার সদস্য হয়ে এ সব কুসংস্কারকে আর গ্রাহ্যের মধ্যেই আনে না। গ্রামেও প্রথম প্রথম বোঝাতে গেছে, এই সব ভূতটুত, শীতলার দয়ায় বসন্ত রোগ, এসব ভুল ধারণা। কেউ কানে তো নেয়ইনি, উল্টে এটাকে তার শহুরে শিক্ষার দেমাক বলেছে।
ভবেশ মন্দিরের চাতালে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই আবার আর্তনাদটা হল একবার। গায়ে কাঁটা দিল ভবেশের। কোনো কুকুর আটকে পড়েছে কি? মন্দিরটার পিছনের দিকে একটা জানলা আছে। ভবেশ পিছনের দিকে এগোলো, মোবাইলের টর্চটা অন্ করে নিল, সাপের ভয় তো আছেই। জানলাটায় একটা টোকা দিল। খুলল না। জানলাটার পাল্লায় এবার একটা বেশ জোরেই ধাক্কা দিল। সঙ্গে সঙ্গে মনে হল কে যেন জানলাটার ওপারে ধারালো কিছু দিয়ে আঁচড় টেনে চলে গেল। পাশের বটগাছটা থেকে কয়েকটা কাক তীক্ষ্মস্বরে চীৎকার করে উঠল। ভবেশের মনটা ক্ষণিকের জন্য দুর্বল হলেও সামলিয়ে নিল। গাছে নিশ্চয় কোনো সাপ উঠেছে। কিন্তু আঁচড়ের শব্দটা? মনের ভুল। কিন্তু জানলাটা যা জোরে আঁটা খোলা যাবে না। আরেকবার ধাক্কা দিল, এবার বেশ কিছুটা জোরেই। বুকের ভেতরটা এত জোর জোর ধকধক করছে কেন কে জানে! ভয় পাচ্ছে? আবার আঁচড়ের দাগটার শব্দ হবে? না হল না। কিন্তু পাল্লাদুটোও খুলল না। ফিরতে যাবে হঠাৎ স্পষ্ট শুনল মন্দিরের মধ্যে কোনো কিছু একটা গড়িয়ে যাওয়ার শব্দ। শিরদাঁড়ার ভিতর দিয়ে বরফের গোলা চলে গেল মনে হল। কে তবে? কেউ বদমায়েশি করছে? চোর? জানলাটা বন্ধ। চীৎকার করে বলতে গেল, কে? কে ভিতরে?
যতটা জোরে আওয়াজ বেরোবে ভেবেছিল, ততটা জোরে হল না, গলার আওয়াজটাও কেমন কর্কশ শোনালো। আবার তীক্ষ্মস্বরে কাক ডেকে উঠল কয়েকটা। খেয়াল করেনি, চাঁদও উঠে গিয়েছে কখন মেঘ কেটে গিয়ে। কয়েকটা কাক উড়ে বেড়াচ্ছে বটগাছটাকে ঘিরে ঘিরে। কয়েক পা পিছিয়ে এসেছে, এমন সময় হঠাৎ একটা আওয়াজ শুনে ফিরে তাকালো। জানলাটা খোলা। লোহার গরাদগুলোর উপর চাঁদের আলো এসে পড়েছে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে কয়েকটা আঙুল দুটো গরাদ জড়িয়ে আছে। কিন্তু মন্দিরের ভিতরটা অন্ধকার। কে? কে ওখানে? পরিতোষ কাকা?
কোনো উত্তর নেই। দমকা হাওয়ায় মনে হল যেন ফিসফিস করে কে বলছে, আয় আয় আয়...
ভবেশ চিত্রার্পিতের মত স্থির দাঁড়িয়ে। ভাবতে পারছে না কি হচ্ছে। আঙুলগুলো নড়ছে। গরাদের ফাঁকে ফাঁকে খেলছে যেন। কি হচ্ছে এ সব? ভাবনাগুলো গুলিয়ে যাচ্ছে। মাথার ভিতরটা দপদপ করছে। একবার মনে হচ্ছে পালিয়ে যায়। কিন্তু পা দুটো অবশ। জিভটাও নড়তে চাইছে না। ধীরে ধীরে জানলাটার দিকে এগোলো, এইভাবে হেরে যাবে নাকি? তাও ভূতের জন্যে? একটা গ্রাম্য কুসংস্কারে?
জানলাটা বন্ধ। কি করে হল? এইমাত্র তো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল খোলা। মানুষ এতটা ভুল দেখে? এইবার খেয়াল করল ভবেশ, তার জামা সম্পূর্ণ ভিজে। এত ভয় পেয়েছে! জানলাটায় আবার একটা ধাক্কা দিল। বন্ধ। তবে? একবার আবার চীৎকার করল, ভূতটুত আমি মানি না... কে আপনি?...
এইবার বেশ জোরে আওয়াজ বেরোলো গলা থেকে। ভবেশের কিছুটা ধাতস্থ লাগছে এখন। নিজেকেও বেশ নিজের নিয়ন্ত্রণে মনে হচ্ছে। যাক, ফেরা যাক। ভবেশ যেই পিছনে ঘুরে ফিরতে যাবে, হঠাৎ মনে হল জানলাটা যেন খুলে গেল। পিছনে ফিরতে যাবে, কিন্তু গলাটা চিপে ধরল কে যেন...... উফ্ কি ঠাণ্ডা হাত...! জানলার ভিতরে কে...!!! দেখতে চেষ্টা করল ভবেশ... কিন্তু চোখে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে... কাকগুলো পরিত্রাহি চীৎকার করছে... সব অন্ধকার... সব...
মন্দিরের ভিতরটা পুরো অন্ধকার। কিন্তু কারা যেন ফিসফাস করে কি সব বলে যাচ্ছে। অনেকে আছে, কিন্তু কাউকে বোঝা যাচ্ছে না। রাস্তা দিয়ে কে যেন যাচ্ছে... কে? কে?... ভবেশ চীৎকার করে উঠল...
নিজের গলা শুনে নিজেই চমকে উঠল... সেই গলা... যে গলা সে বারবার বাইরে থেকে শুনেছে...