Skip to main content
 
 
মাঠের ধার দিয়ে নদী। থমকে দাঁড়িয়ে ধবল ক্ষ্যাপা। সে নদীর পুবপাড়ে না পশ্চিমপাড়ে? কেউ নেইও এদিকটায় যে জিজ্ঞাসা করে। নদীটার দিকে হতাশ চোখে তাকিয়ে, হাতের লাঠিটায় ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ধবল। পাখি উড়ে যাচ্ছে, নদী বয়ে যাচ্ছে, দূরে হাটের হইহই শব্দ আসছে, কিন্তু কেউ তাকে বলার নেই গো সে নদীর কোন পাড়ে? পাশে একটা বন্ধ স্কুল, কি নাম পড়তে পারে না ধবল।
       কুকুর একটা ছুটতে ছুটতে আসছে। ধবলের সামনে এসে ল্যাজ নাড়তে নাড়তে মুখের দিকে তাকালো। প্রসন্ন দৃষ্টি। ধবল হাঁটুগেড়ে বসে পিঠে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞাসা করল, তুই পুব পাড়ে দাঁড়িয়ে না পশ্চিমপাড়ে রে?
       কুকুরটা কি বুঝল কে জানে, সে ওই পারের দিকে মুখ তুলে উউউউউ করে ডেকে উঠে ধবলের মুখের দিকে তাকালো। ধবল একটু ভুরু কুঁচকিয়ে কুকুরের মুখের দিকে তাকিয়ে, ওপারের দিকে তাকিয়ে বলল, ওদিকটা পশ্চিম?
       কুকুর ল্যাজ নাড়ল। ধবল বলল, তার মানে সূর্য ওইদিকে ওই নারকেলগাছগুলোর পিছনে ডুবে যাবে?
       কুকুরটা আরো জোরে ল্যাজ নাড়ল।
       ধবল মাথা তুলে তাকিয়ে দেখল, সূর্য ঠিক মাথার উপরে। কে বলবে সে মাটি ফুঁড়ে বেরিয়েছে আউশগ্রামের পিছনের হোগলা বন থেকে। এবার সব হিসাব মিলে গেছে ধবলের।
       ধবলের গায়ে একটা ছেঁড়া ছেঁড়া কাঁথা। হাতে লাঠি। সে দিল লাফ নদীতে। কুকুরটা কয়েকবার ডেকে ধবলের সাড়া না পেয়ে সেও দিল লাফ জলে। জলের মধ্যে আকাশের সূর্যের তলতলে প্রতিবিম্ব। ধবল সে প্রতিবিম্ব হাতের মধ্যে নিয়ে খেলতে শুরু করল মাঝনদীতে। হাতের মধ্যে জল নেয়, জলের মধ্যে সূর্য - একবার ধরে, একবার জলে ভাসিয়ে দেয়। কুকুরটা ততক্ষণে ওপারে গিয়ে থরথর করে কাঁপছে, পৌষের শীত। কাঁপতে কাঁপতে ডাকছে। ধবল বলল, দাঁড়া দাঁড়া, সূর্যটাকে আগে স্নান করিয়ে নিই, যা ময়লা। ওই আকাশে সারাদিন ছোটাছুটি, তারপর আবার মাটিতে হ্যারিকেন নিভিয়ে ঘুম। রোজ এই এক কীর্তি। তাই আজ একটু স্নান করিয়ে দিলাম বুঝলি। বাড়িতে হ্যারিকেনের কাঁচ মুছিস না? এও তো সেই রে। তুই আরেকটু দাঁড়া বাপু। আমার কাছে সাবুন থাকলে ডলে ডলে স্নান করিয়ে দিতাম, কিন্তু আমি তো গরীব, তায় মাথার ঠিক নেই, আমায় সাবুন কে দেবে বল?
       কুকুরটা কয়েকবার ডেকে কুঁকড়ে বসে থাকল ধুলো মেখে। ধুলোর গরমটা ভালো লাগছে হয় তো।
       ধবল খানিকবাদে এল সাঁতরে। এসেই ধুলোর মধ্যে শুয়ে পড়ল চিৎ হয়ে কুকুরটার পাশে। একগাল হেসে বলল, কি চকচক করছে দেখ সোনামণিকে এখন?
       কুকুরটা তার কোলের কাছে এসে শুলো গুটিসুটি দিয়ে। ধবল তাকে আরো কোলের কাছে টেনে নিয়ে বলল, আয় ঘুমা, আমিও শুই একটু।
       ঘুম ভেঙে ধবল দেখে ঘুটুঘুটে অন্ধকার চারদিক। ভালো করে আকাশটায় সূর্যকে দেখল, নাহ্, নেই। তারা আর তারা শুধু। সূর্য সোনামণির বাড়িতে ফেরার সময়, তার ছোট্টো ছোট্টো পায়ের আঘাতে আকাশটার ধুলোমুলো ছড়িয়েছিটিয়ে তারা হয়ে আছে। তার নিজের সোনামণিও যখন খেলে ফিরত তখন সারা উঠোন এমন ধুলোমুলোয় ছ্যাকরাব্যাকরা হয়ে থাকত। দেখো না, তারাগুলোর কোনো সাজানোর ছিরিছাঁদ আছে? এতো ধুলোখেলাই!
       কিন্তু সোনামণি গেল কোনদিকে? তার সোনামণিও এমন নদীর মধ্যে ডুবে গিয়েছিল। কেউ খুঁজে পায়নি। সে যখনই জলে নামত দিনমানে তখনই এই সূর্যকেই তো দেখত জলে খেলে খেলে বেড়াচ্ছে, ঢেউ তুলছে, নাচছে, গলে যাচ্ছে, গোটা হয়ে যাচ্ছে, আবার হারিয়ে যাচ্ছে। সেই তো জানে তার মাটির সোনামণি কই গেল? সেই কি নিয়ে গেল?
       ধবল চারদিক ভালো করে তাকালো, কুকুরটাও বা কই? সেও কি ডুব দিল সোনামণির সাথে মাটিতে? ধবল বিভ্রান্ত। মাটিতে বসে চারদিক ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে। আজ কি পূর্ণিমা? একটা মস্ত চাঁদ, পুরো গোল থালার মত উঠছে হামাগুড়ি দিয়ে। দূরে কোথাও কুকুরডাকার আওয়াজ। একি আমার কুকুরটা?
       ধবল আবার গুলিয়ে ফেলেছে। কোনদিকে পুব, কোনদিকে পশ্চিম? কোনদিকে তার সোনামণি? মাটির না আকাশের? সব গুলিয়ে যাচ্ছে। লোকে বলে তার নাকি মাথা খারাপ, কথার উত্তর না পেলে কার না মাথা খারাপ হয়?
       ওপার থেকে মন্দিরের কাঁসর ঘন্টা বাজার আওয়াজ আসছে। মন্দিরটা কি পুবে না পশ্চিমে? মন্দিরের ঠাকুরমশায় বলে, মাথা ঠাণ্ডা করো ধবল, ও আর ফিরবে না। ঠাকুরমশায় বলে আর ঠাকুর সিংহাসনে বসে ফিকফিক করে হেসে বলে, শুনিস না ধবল, খোঁজ খোঁজ, পাবি।
       ধবল উঠল। আবার নদীতে ঝাঁপ দিল। তার পিঠের উপর পূর্ণচন্দ্র, ভেসে যাচ্ছে। ধবল ঠিক করল সে মন্দিরে যাবে, তার সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি, ঠাকুরমশায় প্রসাদ দেন। ঠাকুর তার খাওয়া দেখেন। পাশের আমলকি গাছটা নাড়িয়ে বাতাস করে দেন। বলে, ধবল, খা, খা, খেয়ে আবার খোঁজ, তোর সোনামণি অপেক্ষা করছে যে!