১
---
ছেলেটার অনেক ক্ষোভ। প্রথম ক্ষোভ নিজের নাম নিয়ে। শিবদাস ওরফে শিবু। এই নাম একজন ২০১৪ তে কলেজের থার্ড ইয়ারে পড়া ছেলের হয়! শিবু নামটা তাও চলে। তাই স্কুলে, টিউশানে, ফেসবুকে, কলেজে তাকে শিবু বলেই সবাই চেনে, দু'একজন খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছাড়া।
দ্বিতীয় ক্ষোভ। তার বাবার চরিত্র নিয়ে। তিনি রাজ্য সরকারের একটা মাঝারী মাপের চাকরী করেন। বেলেঘাটার পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে গড়িয়াতে ফ্ল্যাট কিনেছেন, সেখানেই থাকেন স্ত্রী বাসবী আর আমাদের গল্পের শিবুকে নিয়ে। তিনি মদ্যপ, সুচতুর বাগ্মী, রাজনীতি আর দুর্নীতি দুটোকেই একসাথে নিয়ে চলেন। আর একটা প্রবাদ বাক্যে ওনার গায়ে জ্বালা ধরে, 'পরস্ত্রী মাতৃসমান'। সুতরাং, শিবুর ক্ষোভের কিছু ন্যায্য কারণ আছে বৈকি। বাবার ল্যাপটপে পর্ণোগ্রাফীর বিপুল সংগ্রহ দেখার পর থেকে তার বাবার দিকে তাকাতে ঘেন্না লাগে। আবার এও মনে হয় এটা তার বাবার ব্যক্তিগত রুচিতে হস্তক্ষেপ হয়ে যাচ্ছে না! বিশেষ করে সুতপা বলার পর। সুতপা শিবুর প্রেমিকা।
তৃতীয় ক্ষোভ। নিজের জ্ঞাতিগুষ্ঠি নিয়ে। বিশেষ করে বাবার দিকের। তারা নিজেদের স্বার্থে তার বাবাকে এন্তার তেল দেয়। কাজ হাসিল হয়ে গেলেই সব নীতিনিপুণ হয়ে গিয়ে তার বাবার নিন্দাতে পঞ্চমুখ হয়ে ওঠে। অসহ্য লাগে তার। তার কাকাতো বোনের দুটো প্রেম, চারবার অ্যাবরশান। তার জেঠার ছেলের এমন কোনো নেশা নেই যা নেই। তার ছোটকাকির পুরোনো প্রেমিকের সাথে আজও সম্পর্ক। তাই নিয়ে মাঝেমাঝেই ক্যাঁচাল। মা গিয়ে সামাল দেন। ঠাকুরদার নাকি একজন রক্ষিতা ছিল। এটা অবশ্য শোনা কথা। তবে চারিদিকে যা সব নমুনা, অবিশ্বাস হওয়ারও কিছু নেই।
এই ক্ষোভগুলো প্রধান। বাকিগুলো ছোটখাটো। যেমন কেন সে লম্বা না, দাড়ি কেন যথেষ্ট না, এখনি কেন মাথায় চুল এত কম! এই সব।
তার মেজাজ প্রায় সব সময়ই চড়ে থাকে। বেশির ভাগ সময়ই কিছু ভাল লাগে না। ঘরে আলো নিভিয়ে শুয়ে থাকে। মোবাইল অফ করে দেয়। সুতপা আর কয়েকজন বন্ধু বুঝে যায় ব্যাপারটা। ওকে আর ঘাঁটায় না।
এত সমস্যার মধ্যে মা আর জেঠুই তার ভরসা। এরা দু'জন বোঝে তাকে। কিন্তু বুঝলে কি হবে? ভাগ্য কি আর কেউ পাল্টাতে পারে? উফ্, আবার সেই বুড়োদের মত কথা! ভাগ্য আবার কি? সব ভুলভাল কথা। নিজেদের দুর্বলতাগুলোকে ঢাকার জন্য এসব যুক্তি। ভাগ্য আবার কি, ধুর!
মা বলেন, বাবু মন খারাপ করিস না, দেখ আমিও তো সব কেমন মেনেই নিয়েছি
- তুমি মেনে নিলে বলেই সবাইকে মেনে নিতে হবে?
-না নিয়ে কি করবি? তোর রাগের কি কোনো প্রভাব এদের ওপর পড়বে বলে তোর মনে হয়? কিচ্ছু হবে না। মাঝখান থেকে তোর শরীরটা খারাপ হচ্ছে। চোখের তলায় কালি পড়ছে, মুখটা শুকনো। যা গিয়ে একবার আয়নায় দেখে আয় নিজেকে।
ধুর, বলে শিবু মায়ের কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ে। আমার কিছুই ভালো লাগে না। মনে হয় দূরে কোথাও পালিয়ে যাই। চলো যাবে?
বাসবীদেবী কিছুক্ষণের জন্য উদাস হয়ে যায়। তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, ওসব ভাবতে নেই। যখন যা হওয়ার তা হবে। তাড়াহুড়ো করলে খারাপ হয়।
- কিন্তু তোমার কখনো পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করে নি? সত্যি বলবে কিন্তু।
আসলে শিবুর ওর মায়ের ক্ষণিক উদাসীনতাটা চোখ এড়ায় নি। বাসবীদেবী ছেলের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন। হ্যাঁ সত্যি বড় হয়ে গেছে। চোখের ভাষা পড়তে শিখে গেছে মায়ের।
-হ্যাঁ করেছে। গেছিও। বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
শিবু উঠে বসল। বলল, তারপর? কোথায় গিয়েছিলে?
বাসবীদেবী বললেন, থাক সে সব কথা বাবু। একটা কথা মনে রাখিস, পালিয়ে যাওয়াটা খুব বড় ব্যাপার না। ভাগ্যে যা আছে, তা মেনে তার মতন করেই রাস্তা করতে হয়। যে মরুভূমিতে জন্মেছে, সে কি বরফ কেটে রাস্তা করবে না বালির ভিতর রাস্তা বানাবে? ভাবিস একটু।
বাসবীদেবী উঠে গেলেন। শিবু অবাক হয়ে কোলবালিশটায় মুখ গুঁজে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল।
২
---
ভোর হয়েছে কখন শিবু টের পায়নি। একটা বই পড়ছিল মন দিয়ে। হঠাৎ টয়লেটে উঠতে গিয়ে দেখল বাইরেটা কিছুটা ফর্সা হয়ে এসেছে। সারারাত জেগে বই পড়া তার কাছে এমন নতুন কিছু না। সাধারণত সে ভোরের সময়টা শুয়ে পড়ে। বাড়িতেও কেউ ডাকেনা ১১ টার আগে। সবাই জানে সে রাত জেগে পড়াশোনা করে।
আজ তার কি মনে হল, সে সোজা ছাদে চলে আসল। এখনো সুর্য্য ওঠেনি। পূর্ব দিকটা লাল হয়ে আছে। দূরে হনুমান মন্দিরে কিছু একটা হিন্দি ভজন চলছে। হনুমান চালীশা খুব সম্ভবত। সেই ছোটবেলা থেকে শুনে আসছে। বেশ শান্ত চারদিক। ফেব্রুয়ারির শেষের দিক, একটু শীত শীত করছে।
হঠাৎ মনে হল সুতপাকে একটা ফোন করবে।
দু'বার পুরো রিং বেজে যাওয়ার পর তৃতীয়বারে সুতপা ফোনটা ধরল।
-কিরে এত ভোরে?
-হুম
-পেট খারাপ?
-ধুর
-মন?
-আরে না!
সুতপার গলাটা সিরিয়াস হয়ে গেল।
-হ্যাঁ রে বাড়িতে সবাই ঠিক আছে তো?
-হ্যাঁ রে। এমনিই ফোন করলাম।
-হুম, বল।
-আচ্ছা আমি কি একটু বেশি অ্যাম্বিশাস?
-হুম... তা কিছুটা বলতে পারিস।
-ইনসেন্সিটিভ?
-সময় বিশেষে। কিন্তু সাতসক্কালে তুই এসব নিয়ে পড়লি কেন?
-এমনি বল না। তোর কথা বলতে কোনো অসুবিধা নেই তো?
-আরে না, তা কেন হবে? বল।
-যা বলছিলিস-
-ও হ্যাঁ ইনসেন্সিটিভ.. যখন খুব ডিপ্রেশানে চলে যাস তখন। তবে তুই খুব সেন্টিমেন্টাল তুই নিজেও জানিস, বলিসও তো।
-সেটা ঠিক। আসলে কি জানিস। আজ সকালবেলাটা কেমন একটা লাগছে। মনে হচ্ছে মিথ্যাই অনেকগুলো দিন নষ্ট করে ফেলেছি। এই সব ভেবে ভেবে। বাবার ব্যাপারটা আমি কোনোদিন মানতে পারব না। কিন্তু মাকে দেখে অবাক হয়ে যাই। কি করে পারলেন এতদিন এরকম একজন হিপোক্রিটের সাথে রাতদিন থাকতে?
-মেয়েরা অনেক কিছু পারে শিবু। সেটা বুঝবি না। আর শুধু কাকুর কথা কেন বলছিস। কাকিমার কি তুই নেই? তুই কাকিমার কত বড় সান্ত্বনা তা যদি বুঝতিস।
-আজ মনে হয় একটু বুঝছি, তুই কি বলছিস। এতদিন স্বার্থপরের মত শুধু নিজের দিকটাই বেশি করে ভেবে এসেছি। আসলে চারিদিকে এমন ঘেঁটে আছে না শালা আমাদের পরিবারটা, যে মাথা ঠিক রাখা শক্ত।
-যা হোক সক্কালবেলা ওসব ভেবে মন খারাপ করিস না। ওতো আছেই। কি বলতো, আমাদের জীবনটা আমরা ওরকম হতে দেব না। কাকিমা যেমন ভাবে জীবনটাকে দেখেন, সেইভাবে দেখতে শিখতে হবে। কাকিমার সবচেয়ে বড় গুণ কি জানিস? কাকিমার সহিষ্ণুতা। তাই উনি এত বড়। কাকুও কাকিমাকে কোথাও সমঝে চলেন এই জন্য।
-দেখেছি
-আসলে কাকিমা তো সহ্য করা ছাড়া উপায় নেই বলে সহ্য করেন না, নিজের ব্যক্তিত্বের জোরে নিজের জায়গায় স্থির থেকে সহ্য করেন। তাই এত জোর ওনার। আজ তোকে একটা সত্যি কথা বলছি। কাকিমার সাথে আমার মাঝে মাঝেই ফোনে কথা হয় শুধু না, উনি আমাদের বাড়িও এসেছেন দু'বার।
-কেন? শিবু আকাশ থেকে পড়ল।
-ওনার যে একটা সবজান্তা গবেট ছেলে আছে, তাকে যেন আমি বোঝাই সেই জন্য। কী রে? রাগ করলি?
-না রে, অন্যদিন হলে হয়তো করতাম। মায়ের সাথে ঝগড়াও হয়তো বাধাতাম। কিন্তু আজ কেমন যেন একটা লাগছে। মনে হচ্ছে এতদিন ধরে ঘুমাচ্ছিলাম যেন।
হঠাৎ মায়ের গলা পেয়ে চমকে তাকালো শিবু পিছনে।
-তুই এখানে?
-হ্যাঁ, সুতপার সাথে কথা বলছিলাম।
-কেন? আবার ভ্যালেন্টাইন ডে পড়ল নাকি রে? কই খবরের কাগজে কিছু পড়িনি তো?
শিবু কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে গেল যেন। কিন্তু এর মধ্যেও মায়ের মুখটার দিকে তাকিয়ে কেমন একটা লাগল বুকের মধ্যে। হঠাৎ জল চলে আসল চোখে। ফোনটা তাড়াতাড়ি কেটে দিয়ে ছাদের কার্ণিশের কাছে মায়ের দিকে পিছন ফিরে দাঁড়াল।
বাসবীদেবীর চোখে পড়ল ঘটনাটা। তিনি তাড়াতাড়ি বললেন, কি অভদ্ররে তুই? ফোনটা এভাবে কাটতে আছে মাঝপথে? দে আমায় ফোনটা।
শিবু ফোনটা না তাকিয়েই মাকে এগিয়ে দিল। তিনি ফোনটা হাতে নিলেন।
-সুতপা আমি কাকিমা বলছি... হ্যাঁ রে ভাল আছি, গুড মর্নিং... শোননা আজ দুপুরে এখানে খেয়ে নে... আরে মায়ের সাথে আমি কথা বলে নেবো... হ্যাঁ রে বাবা... আচ্ছা ঠিক আছে।
এই নে ফোন ধর, সুতপা। আর চোখটা মুছে, কথা বলে নীচে আয়, আজ লুচি বানাচ্ছি।
শিবু চমকে ফিরে মায়ের দিকে তাকালো। তিনি ততক্ষণে কয়েকটা সিঁড়ি নেমে গেছেন।
(ছবিঃ সুমন দাস)