সে সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। জোড় হাতে দূর থেকে প্রণাম করে বলল, পাপী আমি।
“কী সুন্দর মন তোমার। পাপ রাখলে কোথায়?”
সে আরেকটু সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। বলল, আপনি পুরোটা শোনেননি। আমি পাপী। অনাচারী। নীচ।
“কী সুন্দর তোমার মন। পাপ রাখলে কোথায়?”
সে আরো কাছে এগিয়ে গেল। বলল, আপনি আমাকে বিভ্রান্ত করছেন। নিজেকে বিভ্রান্ত করছেন। কেন বুঝতে চাইছেন না, আমি সে নই যা আপনি ভাবেন, ভাবছেন। আমি….
আবার সে একই কথা বলল। উত্তর এলো একই
“এমন সুন্দর মন তোমার। পাপ রাখলে কোথায়?”
=======
সে ফিরছে। দু চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। যত দূরে যাচ্ছে তত তার কানের কাছে বাজছে, “এমন সুন্দর মন তোমার, পাপ রাখলে কোথায়?”
পাহাড়ি রাস্তা। ঘুরে ঘুরে নামছে। যত বাঁক ছাড়িয়ে ঢালু রাস্তা দিয়ে নামছে তত তার কানে একই কথা ঘুরে ফিরে বাজছে। পাশ দিয়ে কেউ কথা বলতে বলতে গেল, তার মনে হল সেও যেন বলল, “এত সুন্দর মন তোমার, পাপ রাখলে কোথায়?” পাখি ডাকল, তার মনে হল আবার সেই একই কণ্ঠস্বর, “এত সুন্দর মন তোমার, পাপ রাখলে কোথায়?”
সমভূমে নেমে এলো। স্টেশানে বসে। ট্রেনের অপেক্ষায়। কী আশ্চর্য, যেদিকে তাকাচ্ছে সব অন্যরকম লাগছে। সামনে একটা ঘেয়ো কুকুর লাইনের ওপাশে শুয়ে আছে। তার মনে হল, এমন সুন্দর কানের গড়ন ক'টা কুকুরের দেখেছে সে? একজন ঠেলাগাড়ি করে কলা বিক্রি করছে, ভীষণ চীৎকার করে। অন্যদিন হলে তার বিরক্ত লাগত। এখন মনে হচ্ছে, ডাকুক। যদি ওর ডাকে কারুর খিদে জাগে। তার দুটো লাভ হয়। তার খিদে মেটে।
তেষ্টা পাচ্ছে। উঠে কলের দিকে এগোলো। জলটা যখন গলা দিয়ে নামল, মনে হল এত মিষ্টি জল যেন জন্মে প্রথম খেল।
হঠাৎ একটা চেঁচামেচি। একটা অল্প বয়েসি ছেলেকে ধরে অনেকে মিলে মারছে। এতদিন এগুলো তার স্বাভাবিক ঘটনা মনে হত। আজ কী হল? সে নিজে বোঝার আগেই ঝাঁপিয়ে পড়ল ছেলেটার গায়ে। আড়াল করল। চীৎকার করে বলল, আপনারা কী পাগল হলেন? এইভাবে একটা বাচ্চাকে কেউ মারে? দরকার হলে পুলিশে খবর দিন….
আরো কী কী সব বলে যাচ্ছিল…. তার নিজের গলার আওয়াজ, যে ভাষার সে কথা বলছিল… তার নিজেরই কানে লাগল….
কেউ বলল, চোরে চোরে মাসতুতো ভাই… কেউ বলল, কে ইনি? পুলিশের কেউ?.... কেউ বলল, ইনি হয় তো আসল পাণ্ডা…. এদের ট্রেনিং দিয়ে পাঠায়……
তার রাগ হল। এক মুহূর্তের জন্য নিজেকে বোকা লাগল। কিন্তু নিজেকে ঘেন্না লাগল না, আগে যেমন লাগত। নিজেকে নর্দমার পোকা মনে হল না। নিজেকে সহায়হীন মনে হল না। আগে এগুলো সব মনে হত। বাইরে হম্বিতম্বি করত যদিও। কিন্তু এগুলো মনে হত।
সবাই চলে গেল। ছেলেটা সামনে দাঁড়িয়ে। তার জামা ছিঁড়ে গেছে। গালে লাল দাগ। আঙুলের দাগ। ছেলেটা হাতজোড় করে বলল, আপনি ভীষণ ভালো মানুষ…. আমি…. আমি ভালো নই…..
তার দিকে সে তাকিয়ে বলল, এত সুন্দর মন তোমার…. ভালো নই বললেই হল…..
ছেলেটা হয় তো তাকে পাগল ভাবল। দূরে পাহাড়টা দেখা যাচ্ছে। যে পাহাড়ে সে উঠেছিল। যে পাহাড়ের চূড়া থেকে সে নামল। ট্রেন ঢুকছে। ট্রেনে উঠে জানলার ধারে বসল। আবার দেখতে পেল ছেলেটাকে। টিকিট কাউন্টারের পাশে দুটো পা পেটের কাছে জড়ো করে বসে আছে, কলা খাচ্ছে। তার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই ছেলেটা চোখটা নামিয়ে নিল। সে নামালো না। তাকিয়েই থাকল। ট্রেনটার ইঞ্জিন হর্ণ দিল। নড়ে উঠল ট্রেনটা। ছেলেটা তাকালো আবার। অল্প হাসার চেষ্টা করল। প্রথমে হাসিটা এলো না। তারপর এলো।
চোখ ভরে এলো জলে। জানলার বাইরে এখন সবুজ মাঠ আর ছোটো-ছোটো পাহাড়। চোখ বন্ধ করে মাথাটা পিছনে ঠেকালো। কী বদলে গেল? নিজেকে সহায়হীন লাগছে না আর। কী আশ্চর্য লাগছে। এমন সহায় বুকে জন্মায়?