Skip to main content
 
 
জানলার ধারে একটা টেবিল ছিল। তার উপর ফুল আর পাতা সেলাই করা দারুণ একটা টেবিলক্লথ পাতলাম। একটা কাঁচের ফুলদানি রাখলাম, তাতে বাগান থেকে ফুল এনে রাখতাম, নতুন জল দিতাম রোজ, ফুলের সাথে পাতাগুলোও তরতাজা থাকত। টেবিলের একদিকে একটা দোয়াত রেখেছিলাম, তাতে ডোবানো কলম, আর কিছু সাদা পাতা; চিঠি লিখতাম রোজ। জানলাটা ছিল পুবদিকে। রোজ সকালে রোদ আসত, আমার টেবিলের উপর পড়ত, ফুলগুলোকে ছুঁয়ে আদর করত, আমি চিঠি লিখতে বসতাম। ভালোবাসার কবিতা, স্বপ্নের গান, আগামী দিনের পরিকল্পনার প্রবন্ধ - লিখে লিখে পাঠাতাম তাকে, যাকে নিয়েই আমার শূন্য প্রহর কাটে।
 
       ধীরে ধীরে অন্ধকার হত। টেবিলের উপর একটা প্রদীপ জ্বালাতাম। সাদা কাগজে ছবি আঁকতাম, মনের মাধুরী মিশিয়ে, সবটুকু প্রাণ উজাড় করে, দারুণ সুখী হয়ে।
       একদিন ঘুম ভেঙে উঠে দেখি দোয়াতটা সব কালিশুদ্ধ মেঝেতে ভেঙে পড়ে, ফুলদানিটার ফুলগুলো এদিক ওদিক ছড়িয়ে, ফুলদানিটা চারভাগে আছে ভেঙে। সব সাদা পাতাগুলো গেছে উড়ে। আমার কলমটাও পেলাম না সাতদিন ধরে খুঁজে।
       রাতে ঝড় এসেছিল নাকি। আমি ছবি আঁকতে আঁকতে ঘুমের ঘোরে চলে গিয়েছিলাম, জানলার পাল্লাদুটো ছিল খোলা। কে জানত সারা আকাশ জুড়ে জমেছে এমন বিধ্বংসী মেঘ, কি ভীষণ ষড়যন্ত্র, কি ভীষণ আমি বোকা!
       রাগে, অভিমানে টেবিলটাকে টুকরো টুকরো করে ভেঙে নিয়ে ভাসিয়ে দিলাম। এক টুকরো সাদা পাতা ধার করে চিঠিতে লিখলাম, হলাম সন্ন্যাসী। সত্যি সত্যিই বিবাগী হলাম না, ঘরের দরজা দিয়ে মেঝেতে শুয়ে রইলাম, বললাম সূর্যের আলো পর্যন্ত ঢোকা নিষেধ আমার ঘরে, আসতে হয় আসুক কেবল যম।
       যম এলো না। একদিন শেষরাতে শুনি বাইরে তুমুল ঝড়ের আওয়াজ। মনের মধ্যে হঠাৎ কেমন বেয়াড়া খুশীর জোয়ার এলো। ধুম করে দিলাম জানলাটা খুলে। ঝোড়ো হাওয়া আমায় ঠেলে ঢুকল ঘরের ভিতর। ঝড়কে দেখে আমার আনন্দ হল, ভয় করল না একটুও, এই প্রথম। ঝড় থামল যখন তখন শুকতারা আমার জানলার ঠিক মাঝখানে। দেখতে দেখতে সূর্য উঠল, আমার শূন্য ঘরের মেঝেতে বসল বন্ধুর মত। বলল, কেমন আছো? এতদিন বাইরে থেকে ফিরিয়েছিলে যে?
       কিছু বললাম না। শুধু তাকিয়ে দেখলাম আমার এত বড় ঘর! এত আলো ধরে তাতে?
       অন্ধকার হল। জানলা আকাশের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, দেখো।
       দেখলাম তারায় তারা ভরা, আমার জানলা ছেঁচা আকাশ জুড়ে। এত তারা নিয়ে আসে আমার জানলা? এত তার সখ্যতা ওই আকাশের সাথে?
 
 
       আমি বললাম, আমি আসি, আমায় তার কাছে যেতে হবে, তাকে বলতে হবে, তুমি এসো, আমি আর নই গো দীন। তাকে গিয়ে বলি, তুমি যদি না আসো আমার এমন সুখের কথা ভাগ করি কার সাথে?
       হঠাৎ মন বলল, যদি সে না আসে? যদি বলে আসলে তুমি গরীব, ভুলিও শুধুই ভাবের ছলনা নিয়ে এসে!
       বললাম, না আসুক, আমার সারাটা ঘর জুড়ে এই কথাটাই সত্য হবে, তাকে আমি চেয়েছিলাম আমার সব শূন্যতা ভরে।