মেঘ নেই। গুমোট গরম। গা ভেপে ভেপে তাপ উঠছে। ঘাম গড়াচ্ছে সারা গা বেয়ে, যেন পাহাড়ি নদী।
আঁশটে গন্ধ। বাজে গন্ধ। একটা জানলার ভিতর দিয়ে তাকিয়ে থাকে একটা ঘর। যে ঘরের ভিতরে রাতদিন অন্ধকার।
কার্তিক ঘরে ঢোকে না। বারান্দাতেই থাকে। মাঝে মাঝে রাঁধে। মাঝে মাঝে ভুখা। এই ঘরে গলায় দড়ি দিয়ে মরেছিল তার বোন। জবা। মা বাপ মরা ভাইবোন। দুজন, দুজনের ছিল। কী হল? লোকে যা বলে বিশ্বাস করে না কার্তিক। ও নিয়ে ভাবতে চায় না। কিন্তু ও নিয়ে ভাবা ছাড়া অন্য কোনো ভাবনাও মাথায় আসে না।
=====
সামনে ঝোপঝাড়। তারপর রাস্তা। রাস্তার ওদিকে মাঠ। আরো এগোলে পুকুর। মেঝেতে শুয়ে শুয়ে কার্তিক তাকিয়ে পুকুরের উপর বকের ওড়া দেখছে। দেওয়ালে লোকনাথবাবার ছবি ঝোলানো। সেদিকে দু একবার তাকালো।
ঈশ্বর মানে সব। ভালো-মন্দ। পুণ্য-পাপ। সুদিন-দুর্দিন। সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্য। সব নিয়ে ঈশ্বর।
এ তার কথা না। কালীবাড়ির দিদির কথা। সাধিকা নাকি সে। লোকে ঝাড়ফুঁকের জন্য যায়। তাকেও নিয়ে গিয়েছিল গ্রামের লোকে। কালী তার দিকে তাকিয়ে জিভ ভেঙিয়ে হাসছিল। কার্তিক অন্যদিকে তাকিয়ে বসেছিল।
=======
কার্তিকের চোখে ঘুম আসছে। আবার জাগাও যাচ্ছে না। চোখটা টাটাচ্ছে। বেলা এগারোটা হবে। খিদেও পাচ্ছে। কিন্তু সকালেই বমি হল। হঠাৎ উঠে বসল কার্তিক। কী শোনা যাচ্ছে…..
“বলো হরি, হরি বোল”.....
কার্তিক উঠে বসল। মনটা নেচে উঠল। কে গেল? ওগো কে গেল? কে? কে?
======
কার্তিক শ্মশানের দিকে যাচ্ছে। সামনে একদল কীর্তন গাইছে। “হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে”..... বিপিন মাস্টারের ছেলে মরেছে। বাইক অ্যাক্সিডেন্টে। শুনেছিল। ভুলে গিয়েছিল কার্তিক। বিপিন মাস্টার পাথরের মত হয়ে গেছে। যেন বাজ পড়া নারকেল গাছ হাঁটছে। সামনে ছেলেটাকে কাঁধে নিয়ে যাচ্ছে বন্ধুবান্ধব ওর। বিপিন মাস্টারের বউ মরেছে সেই কবে। এবার শালা বুঝবি জীবন কাকে বলে! কার্তিকের কান্না পাচ্ছে। আবার মনে হচ্ছে পুকুর একটা ডুব দিয়ে আসে। দুটো সাদা ভাত ফোটায়, আলুসেদ্ধ দিয়ে। গস গস করে গেলে। কার্তিকের চলায় নাচের ছন্দ ফুটে উঠছে। কার্তিক চাপতে চাইছে। পারছে না।
=======
লাইন আছে। কার্তিক চায়ের দোকানে বসল বেঞ্চে। এখানে অনেকে তাকে চেনে। এই দোকানি। ওই দোকানি। এই কুকুর। সেই কুকুর। এই ভিখারি। সেই ভিখারি। সবাই চেনে।
হালকা মেঘ করে এসেছে। হাওয়া দিচ্ছে।
কার্তিক একটা কেক আর চা নিল। এখানে এরাই খাওয়াবে। কার্তিকের শ্মশানে এলে বড় নিশ্চিন্ত লাগে। এরপর আর কিছু ভাবার নেই তো। শিয়ালদার মত। ট্রেন আর এগোয় না। এগোবে কী করে, শালা সামনে রাস্তা তো! শ্মশানে পুড়ে মানুষ কোথায় যায়? কেউ জানে না। জানে না বলেই যাকে পোড়াতে এসেছিল তার সঙ্গে যায় না, আবার সংসারে ফিরে আসে নাভি ভাসিয়ে জলে।
=====
কার্তিক চা কেক খেয়ে গঙ্গার ধারে এলো। মা গঙ্গার মূর্তি। জগন্নাথদেবের মূর্তি। কালী। দুর্গা। এরা সবাই মৃত্যুর ওপারে থাকে। এ পারে কেন আসে? জবা জানে। এ জবা…জবা? এ জবা…শুনতে পাচ্ছিস?
কার্তিক শ্মশানে এলেই ফিসফিস করে জবাকে ডাকে। জবাকে এখান থেকেই তো নিয়েছিল আগুন। চুল্লীর আগুন। এ জবা….শুনছিস….এই…
======
কার্তিক খুচরো পয়সা খুঁজছে। ভাঙা, নোংরা মূর্তিগুলোর সামনে লোকে দেয়। ও পয়সা নিয়ে ঠাকুর কোত্থাও যায় না। আর এমনি লোকে নিতে ভয় পায়, ভাবে পাপ লাগবে। পাপের ভয় নেই কার্তিকের। সে শ্মশানে এলেই পয়সা কুড়ায়। পয়সা নিতে নিতে দেখল বিপিন মাস্টার বিড়বিড় করে কী সব বলে যাচ্ছে। ওর এখন কাঁদা দরকার। নইলে বুকে চাপ চাপ ব্যথা হবে।
=====
কার্তিক গুনে দেখল একত্রিশ টাকা হল। এক টাকা রেখে দিয়ে ত্রিশটাকা করে নিল। তারপর ঘাটের ধারে একটা সিঁড়িতে বসে একটা কুকুরকে আদর করতে শুরু করল। কুকুরটা বসে বসে অনেকক্ষণ ধরে কার্তিককে দেখছিল। চেনা কুকুর। কিন্তু কার্তিক তো তার মালিক নয়। চেনা। তাই ওঠেনি। এ যুক্তি কার্তিকের।
কুকুরটা কয়েকবার আদরে আপত্তি জানিয়ে শেষে কার্তিকের কাছে হার মানল। মাঝে মাঝে কেঁউ কেঁউ করে উঠল দুবার। কার্তিকের চোখ বিপিন মাস্টারের দিকে। কী বলে যাচ্ছে লোকটা! তার পাশে কেউ নেই। সবাই এদিক ওদিক জটলা করছে। গুলতানি মারছে। মাল এনেছে নিশ্চয়ই কেউ। কার্তিক মদ খায় না। বড় গন্ধ!
======
দাহ হল। টলতে টলতে নাভি ভাসাতে নামল বিপিন মাস্টার। কার্তিক হাতটা ধরল। শ্মশানে মানুষ বদলে যায়। অল্পক্ষণের জন্যে হলেও। পড়াশোনা, জামাকাপড়, টাকাপয়সা, গাড়িবাড়ি সব ছাই মনে হয়। যে মানুষকে ঘিরে এত কিছু, সে-ই যেখানে ছাই….বাকিসবের আর কী কথা!
কিন্তু কাঁদছে না লোকটা। কারুর কারুর মুখে ইতিমধ্যে মদের গন্ধ পেয়েছে কার্তিক। জবাকে পোড়াতে এসেও পেয়েছিল। কিছু বলেনি। কী বলবে? শালাগুলো মানুষ!
কার্তিক জানে সবার সব কিছুতে শ্রদ্ধা থাকে না। জীবনে না, মরণে না। শ্রদ্ধা হারালে জীবনের তেল শেষ। মানুষ বাঁচে কী নিয়ে তখন?
হঠাৎ বিপিন মাস্টার বলল, সেই বাজখাঁই গলায় বলে উঠল, এই তোরা সব কচুরি খেয়ে বাড়ি যাবি…বেলা অনেক হয়েছে……
এ গলা ভালো না। ভালো না। এরা বুঝছে না!
=======
বাড়ি ফিরে এলো যখন সন্ধ্যে হব হব। কার্তিক বারান্দায় কিছুক্ষণ গড়ালো। তারপর উঠে বিপিন মাস্টারের বাড়ির দিকে গেল। দোতলা বাড়ি। সামনে একটা মুদির দোকান। তারপাশে গলি। কার্তিক গলির মুখে দাঁড়িয়ে থাকল। অনেক লোক বাড়িতে। কিন্তু কদিন?
======
প্রায় মাস খানেক হল রোজ সন্ধ্যেবেলা এই গলির মুখে দাঁড়িয়ে থাকে কার্তিক। বিপিন মাস্টারকে দেখে। এ কদিনেই কী বুড়িয়ে গেল লোকটা। জবা দেখেছিস….এ বাঁচবে না বেশিদিন….জবা দেখেছিস?
=======
কার্তিক শুনল বিপিন মাস্টার এখানের বাড়ি বিক্রি করে দুর্গাপুরে বোনের কাছে চলে যাচ্ছে। কিন্তু কেন? মানুষটা তো আরো মরে যাবে! এখানেই তো সব ওর। সব স্মৃতি। এতবড় ভুল কী করে করতে পারে এত লেখাপড়া জানা মানুষ একজন?
কার্তিক কদিন ইতস্তত করে একদিন ঢুকেই পড়ল বিপিন মাস্টারের বাড়ি।
বাইরের গেটটা খুলে একটা ছোটো বাগান। রাত সাড়ে আটটা হবে। বিপিন মাস্টারকে বাইরেই দেখল, একটা চেয়ারে বসে, পাশে মোবাইলে গান চলছে।
বিপিন তাকে দেখেই ধড়ফড় করে উঠে বসে বলল, আরে কার্তিক! কী খবর তোমার?
কার্তিক যেখানে দাঁড়িয়েছিল ওখানেই বসে পড়ল। বসেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল, আপনি যাবেন না স্যার….ছেলেটা একা হয়ে যাবে যে….
=======
সংসারে সব কথা ব্যাখ্যা করে বোঝাতে হয় না। আবার ব্যাখ্যা করতে গেলে সে কথার মানে ব্যাখ্যায় চাপা পড়ে কী একটা অর্থ দাঁড়ায়।
বিপিন মাস্টার ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ কার্তিকের দিকে। আধখানা চাঁদের আলোয়, আর দরদের আলোয় কার্তিকের দিকে তাকিয়ে বলল, জবা কদ্দিন হল নেই রে…..বড় ভালো ছিল মেয়েটা……
কার্তিক কয়েকবার ফুঁপিয়ে শান্ত হয়ে বসল। তারপর হাঁটুতে চাপ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। বিপিন মাস্টার বসে তাকিয়ে আছে কার্তিকের দিকে। বলল, এ গোটা বাড়ি যেন খেতে আসে কার্তিক…..তাই…..
কার্তিক কিছু বলল না। মানুষ তো এমনই স্বার্থপর। ছেলেটার কথা একবারও ভাবল না। এ শ্মশানের মত আত্মীয় আর কোথায় পাবে লোকটা? একাকীত্ব থেকে পালাতে গিয়ে আরো একা হয় মানুষ। একাকীত্ব যাকে একবার ছুঁয়ে ফেলেছে, কোনোদিন কোথাও তাকে আর ছেড়ে যায় না….
আর কোনোদিন আসেনি কার্তিক বিপিন মাস্টারের বাড়ির সামনে।
বিপিন মাস্টার বছর চারেক পর ফিরে এসেছিল যদিও। মন বসল না কোথাও। কার্তিকের কথাই সত্যি হল। বিপিন মাস্টার এসেই কার্তিকের খোঁজ করেছিল। কিন্তু কার্তিক সেদিন কোথায়? সে তো শ্মশান পেরিয়ে ওপারে চলে গেছে মাস দশেক হল।