Skip to main content

কথাটা এই মাথাটা গরম হচ্ছে। সারাদিন কাজের ফাঁকে ফাঁকে একটা রাগ সারাটা শরীর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। শুধু রাগ? না, শুধু রাগ না, অপমান লাগছে। হ্যাঁ অপমান লাগছে। গায়ে ফোস্কা পড়ার মত না। বোধহয় চিতায় সজ্ঞানে বসার মত - সঠিক উপমা হতে পারে, জ্বলুনীটা বোঝানোর জন্য। কারণ সত্যিকারের চিতায় তো বসিনি কখনো।


কাজের মাঝখানে নোটিফিকেশান এলো - ১৮ জন। অর্থাৎ সব মিলিয়ে আঠারো জন সেনা মারা গেলেন। না, বড্ড দুর্বল শব্দ শোনালো, শহীদ হলেন? তাও যেন ঠিক নয়, বলি হলেন বলা যায়? হয় তো যায়। কূটনীতি বুঝি না। কিছুটা মানবনীতি বুঝি। রাজনীতি? ওটাকে আমি মানবনীতির একটা শাখাই বলতে পারি। ঠিক যেমন অর্থনীতি। আর এই সবের মূল একটাই বড় শব্দ - মানবনীতি।
পাকিস্তান বলছে আমরা দায়ী না। খবেরর কাগজ বিভ্রান্তিটার গোড়ায় আরো উস্কানি দিয়ে চলেছে, যত না এদেশের ওদেশের তার চাইতে বেশি। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শোরগোল উঠেছে - পাল্টা আক্রমণ হোক! সময় এসে গেছে, আর হাত পা গুটিয়ে বসে থাকলে চলছে না। চাপ বাড়ছে। আক্রমণের উদ্দেশ্য বলা হচ্ছে - কাশ্মীরের ঘটনার প্রতিশোধ। হয় তো বা তাই।


বলা হচ্ছে, আগে থেকেই আমাদের ইন্টেলিজেন্সীর কাছে খবর ছিল, সুতরাং আগে থেকে সতর্ক করা সত্ত্বেও কেন এই রকম অব্যবস্থা ছিল, তা স্বভাবতই প্রশ্নের মুখে আসছে। এরকম আরো জটিল সব তথ্য মাথা ভিড় করছে। বলা হচ্ছে, আতঙ্কবাদীদের চালচলন বদলেছে, আগে সাধারণত শুধু অবিবাহিত তরুণেরা এর সাথে যুক্ত থাকত। এখন বিবাহিত, মাঝ বয়সী, বাচ্চা, কিশোর ইত্যাদি সব বয়সীদের ব্যবহার করা হচ্ছে। তাদের চিহ্নিত করা মুশকিল এরকম নানা খবর। ঘুমিয়েই মারা গেলেন যাঁরা তাঁরা জানতেও পারলেন না, কার বা কাদের দোষে ঘুমন্ত অবস্থায় প্রাণ দিতে হল তাঁদের।

তথ্যাবলী থেকে সরে আসা যাক। পাকিস্তানকে একঘরে করে দেওয়া হবে নাকি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হবে – সে খুব সহজ সিদ্ধান্ত না। একটা কথা ভাববার। ভাবনা চিন্তা চলছে চলুক।


মুশকিলটা কি লাগে বলুন তো, যারা মারা যান তারা চিরটাকালই আমার আপনার পাশের বাড়ির আমার আপনারই মত কেউ। তখন আলোচনটা আর তাত্ত্বিক করা যায় না। খুব বড় একটা দর্শনে চাপা দিয়ে সেই ব্যর্থতাটাকে ঢাকাও যায় না। সেনায় গেছে মানেই ও বেঘোরে মরবে, এতে আর শোক পালনের কি আছে? এই যদি মানসিকতা হয় তবে অবশ্য এটা খুব বড় খবর না। গতকাল লিখেছিলাম না, ‘সবাই আর ওরা’ – এখানেও তো তাই, ওরা তো সৈন্য আর আমরা সবাই তো সাধারণ নাগরিক, অগত্যা শোকের মধ্যে একটা বীর্যবান তকমা বা শহীদ তকমা তো লাগানো যেতেই পারে। যারা মারা গেল, তারা তো দেশের জন্য প্রাণ দেবে বলেই সেনাতে যোগ দিয়েছিল। সুতরাং জেগেই মারা যাক কি ঘুমিয়েই মারা যাক, লড়েই মারা যাক আর নিরস্ত্র মারা যাক, শহীদ তো হল। আরা কারা যেন পিঠ বাঁচাল।


আতঙ্কবাদ সর্বোচ্চ যে ক্ষতিটা করতে পারে, তা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ততটা না, যতটা মানসিক। তার প্রধান কাজই হল আতঙ্ক সৃষ্টি করা। যে কোনো দেশের আভ্যন্তরীন সাম্যতাকে বিঘ্নিত করা। সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রশাসনের উপর নির্ভরতার ভাবকে বিনষ্ট করে একটা নৈরাজ্যর দিকে নিয়ে যাওয়া। সর্বোপরি যে গণতন্ত্র ব্যবস্থায় আস্থা রেখে সারা বিশ্বের প্রধানতম অংশটা নিজেদের সমস্যাগুলো সমাধানের মাধ্যমে প্রগতির পথ খুঁজছে তার মূল ধরে নাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা। এটা করতে সে যতটা সার্থক সে ততটাই সফল।


কিন্তু তা হয় না। আর কোনো কালেই তা হবে না। আগুন জ্বলবে, ধোঁয়ায় ধোঁয়া হবে চারদিক, কিন্তু সে ধোঁয়া সরে গেলে কোনো আতঙ্কবাদী নেতাই সেখানে নিজ প্রাসাদের ভিত্তি প্রস্তর দেখবেন না। তাদের জোর থাকতে পারে, পৈশাচিক উন্মাদনা থাকতে পারে, মৃত্যুভয় শূন্য আদর্শের প্রতি আনুগত্যও থাকতে পারে। কিন্তু সব শেষে ফলাফল শূন্যই দাঁড়াবে।


কারণ মানব সভ্যতার ভিত্তি তৈরি হয়, আত্মসম্ভ্রমের পরাকাষ্ঠায়। আত্মসম্ভ্রম কোনোদিন অন্ধকারের আশ্রয় নেয় না, তা কোনোদিন পিঠে ছুরি মারার কৌশল সেখায় না। সে সম্মুখ সমর বোঝে। আজকাল অনেকে দেখি দরিদ্রতাকে আতঙ্কবাদী তৈরী হওয়ার এক বড় কারণ বলে থাকেন। তাদের মধ্যে বহু নাম করা অর্থনীতিবিদ, চিন্তাবিদ আছেন। আমার কোথাও যেন কথাটা মানতে অসুবিধা হয়, অতি সরলীকরণ মনে হয়।
গরীব মানুষ মানেই তার মধ্যে একটা আতঙ্কবাদী হওয়ার সম্ভাবনা আছে – এ নিতান্তই মনুষ্যত্ত্বকে অসম্মান করা। কিসের অহংকার বশে এ তত্ত্ব জানিনা। কারণ এ তত্ত্বের প্রধান প্রণেতাগণের মধ্যে মার্কিনিগণ বেশি। গরীব মানুষও মাথা তুলে হাঁটার যোগ্যতাকেই শ্রেষ্ঠ মানবীয় সম্মান বলে মনে করেন, এ আমার একান্ত ব্যক্তিগত মতামত না, ইতিহাস সাক্ষী, আর তার চাইতেও বড় সাক্ষী আমাদের দৈনন্দিন জীবন। আমাদের চারপাশ। যে কোনো মূলগত প্রধান তত্ত্বই সার্বজনীন। যাকে fundamentals বলি।


Human dignity বোধটাও তাই। সেটা মনুষ্যত্ত্বের মূলধর্ম। তাকে দূষিত করা যায়, সে ধর্মের মূলচ্ছেদ করা যায় না। আজ যা চলছে, তা হল দূষণ। আর আজ প্রতিবেশি দেশগুলোর সেই আতঙ্কবাদীর দলে নাম লেখানো যুবকদের তালিকা দেখলে বোঝা যাচ্ছে তারা যে শুধু গরীব, বঞ্চিত, শোষিত সম্প্রদায়ের থেকে আসছে, তা না। সুতরাং এ দূষণকে কি করে রোধ করা যায় তা ভাবতে হবে। তা শুধু যুদ্ধ করে, ভাষণ দিয়ে, কূটনীতিকে প্রয়োগ করে সম্ভব, তা কিন্তু নয়।


‘DOES TERRORISM WORK? A HISTORY’ বলে একটা বই প্রকাশিত হয়েছে Oxford University Press থেকে। লেখক রিচার্ড ইংলিশ। ভদ্রলোক তিরিশ বছর এই বিষয়ের উপর গবেষণা করে এই বই লেখেন। তাতে চারটে প্রধান আতঙ্কবাদী গোষ্ঠীর উপর আলোচনা আছে। তাতে প্রথম অধ্যায়টা ‘আল- কায়দা’ গোষ্ঠীর উপর। বোঝা যায় দূষণ কাকে বলে। কি সাংঘাতিকভাবে একটা ধর্মকে আশ্রয় করে তৈরি হতে পারে। কি ভাবে বিকৃত করা যায়, ক্ষমতার লোভে ব্যবহার করা যায় একটা ধর্মকে। তিনি ‘calm, measured and patient reaction’ এর কথা বলছেন এই বইটাতে। সে তো না হয় প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে। তা যুক্তিসঙ্গতও। কারণ যে সিঁদ কেটে ঢোকে, সে আর যা হোক যুদ্ধে যেতে চায় না। তার জন্য ব্যবস্থা কি নেওয়া উচিৎ সে আলোচনা বড় জটিল আগেও বলেছি।


শুধু এটুকুই বলা, মনুষ্যজাতির দূষণ যারা ঘটাচ্ছে তারা মৃত্যুর উপত্যকায় বাসা গড়েই তা ঘটাচ্ছে। তাদের সাথে, তাদের লড়ার পদ্ধতি শুধু গোলা বন্দুকে সম্ভব না। সুশিক্ষা, সাম্যতা প্রতিষ্ঠা আর সব প্রকার মৌলবাদকে (যা কিছু অবৈজ্ঞানিক ও অযৌক্তিক) উৎখাত না করলে এ পথে এগোনো মুশকিল। শেষ করি আবারও এই কথা বলে আতঙ্কবাদ একটা মানবীয় দূষণ যা প্রক্ষিপ্ত, তা কখনোই স্বাভাবিক না, আর তা কোনোদিনই দরিদ্রতাজাত না, দরিদ্রতা কোনোভাবে তাকে প্রভাবিত করে মাত্র, জন্ম দেয় না।


( আর সবার কাছে আমার ক্ষমা প্রার্থনা, কারণ যে ভাষায় এটা পড়া হবে, সেই ভাষাভাষীরা এত পূজো, পিঙ্ক(সিনেমা) ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত যে খুব একটা পোস্ট এই বিষয়ে দেখিনি। সে ভালোই, কাশ্মীর অনেক দূর। আর আমরা আগে বাঙালী পরে ভারতীয় – কি বলেন? এসব তুচ্ছ, রোজকার বোরিং বিষয় ছেড়ে...আচ্ছা আপনার পূজোয় এবার কি প্ল্যান...আসুন না আলোচনা করি..) .