গ্রীষ্মকাল। প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। হাওড়ার সালকিয়ায় থাকি তখন। ঘিঞ্জি শহর। ছাদে সবাই শুয়েছি। গরমকালে তখন তেমনই শোয়া হত। অনেক রাত। আমার ঘুম আসছে না। পাশে সবাই ঘুমাচ্ছে। মাঝে মাঝে হাওয়া দিচ্ছে আর সামনের অশ্বত্থ গাছের পাতাগুলো হাততালি দেওয়ার মত আওয়াজ করে উঠছে। আকাশে চাঁদ। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের দল ভেসে যাচ্ছে। অল্পক্ষণের জন্য চাঁদকে ঢেকে দিচ্ছে, ছাদটা অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। আবার মেঘ সরে যাচ্ছে, ছাদটা আলোয় ভরে যাচ্ছে।
আমি জানি চাঁদটা স্থির। মেঘগুলো ভেসে ভেসে যাচ্ছে। কিন্তু আমি অন্যভাবে ভাবাতাম নিজেকে। মনে করতাম মেঘগুলো আসলে স্থির চাঁদটাই ভেসে ভেসে যাচ্ছে। আমাদের এই ছাদটাও ভেসে ভেসে যাচ্ছে। আসলে এটা ছাদ না এখন, এটা জাহাজ। আর ওই চাঁদটা আমাদের জাহাজের নাবিক। কোথায় যাচ্ছি কেউ জানি না। কিন্তু সবাই যাচ্ছি।
যা ঘটছে তাকে অস্বীকার করে আমার ভাবনার চোখে দেখার মধ্যে যে সুখ আছে, সেদিন টের পেয়েছিলাম। অজান্তেই টের পেয়েছিলাম। মানুষ ওভাবেই এই খেলাটা শিখে নেয়। শুনেছি শিশু মাতৃজঠরে থাকার সময়েই নাকি বৃদ্ধাঙ্গুলিটা চুষতে শিখে যায়, নইলে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর মাতৃস্তন থেকে নিজেকে বঞ্চিত করবে যে।
এও তেমনই। যত সে বড় হবে ততই তো তাকে এমন অনেক চলমান চাঁদ আর স্থির মেঘের দল বানিয়ে নিতে হবে, কোথাও এক ইঞ্চি না গিয়েও আলোকবর্ষ দূরত্ব পাড়ি দেওয়ার কল্পনায় বাঁচতে শিখতে হবে। উনি লিখেছিলেন "সত্যেরে লও সহজে", সেকি উনি নিজেও পেরেছিলেন? পারেননি। আর পারেননি বলেই আমরা ওনাকে পেয়েছি। নইলে অমন স্থিতপ্রজ্ঞ হিমালয়বাসী মানুষের তো অভাব ছিল না, তা নিয়ে আমরা কি করতাম?
গীতাতেও এই দুষ্টুমিটার কথা পড়েছিলাম। বলে নাকি এই সংসারটা উল্টা অশ্বত্থ গাছের মত। সমস্ত সৃষ্টি তার পাতাডালপালা। যা ঝরে ঝরে যায়। মূল এক থাকে। সেই মূল অনন্তে গিয়ে মিশে যায়।
সে মিশুক না মিশুক। কিন্তু সবটা উলটে দেখার তত্ত্ব ওনার মাথাতেও এসেছিল তবে। সোজা রাস্তায় সোজা হেঁটে মানুষ কি পায়? কিচ্ছু না। উলটো দিকে হাঁটলে তার মত করে সে কিছু একটা পায়। নিজেকে হারিয়ে নিজেকে পায়। কল্পনায়। সেখানে সে ঈশ্বর বানায়। বৃন্দাবন বানায়। বাঁশিওয়ালাকে খুঁজে পায়। একজোড়া নুপুর বাঁধা পা খুঁজে পায়। গান বাঁধে। মৃত্যুকে আর জীবনকে দুটো চাকার মত পাশাপাশি রেখে বলে, তোমরা ঘুরে যাও। আমি তোমাদের ঘোরার বাইরে এসে দাঁড়িয়েছি। এও কল্পনা তার। তবু এই কল্পনাতেই তো সে বাঁচে। নইলে শুধু গাছের ছাল পরেই তো দিন কাটত। পোশাক বানাল কেন, আর সে পোশাকের গায়ে ছবিই বা আঁকতে গেল কেন? কারণ মানুষ জানে, তার প্রয়োজনটা সীমায় বাঁধে, তার কল্পনাতে সে অসীমে ডোবে। দুই সত্য। একটা জাগতিক, একটা তার নিজের। যার নিজের দিকে ঝোঁকটা বেশি, তাকে তখন জগত বলে ক্ষ্যাপা। যার ওদিকের দিকে ঝোঁকটা বেশি, তাদের বলে কাজের মানুষ। দুজনকেই সংসারে লাগে। কেউ বাঁশি বানায়। কেউ বাঁশি বাজায়। তবেই এ সংসার চলে। কাউকে বাদ দিয়ে ভাবতে গেলেই সব গোল্লা।