Skip to main content

 

সুফলের মা রেলে কাটা পড়ার কিছুক্ষণ বেঁচে ছিলেন। একটাই কথা মাথায় এসেছিল, এভাবে তো মারা যাওয়ার কথা ভাবেননি কোনোদিন। জীবনের এক এক সময়ে এক এক ধরণের মৃত্যুর কথা ভেবেছেন। সুগার, প্রেশার ছিল। ওভারিতে সিস্ট ছিল। মা ক্যান্সারে মারা গিয়েছিলেন। বাবা হার্ট অ্যাটাকে। স্বামী কিডনি ফেলিওয়রে। সুফল কোভিডে।

সুফলের মা বুঝতে পারেননি ট্রেনটা গ্যালোপিং ছিল। কানে কম শোনেন। হর্ন শুনতে পাননি। ছড়িয়ে পড়া সদ্য বাজার করা সব্জীগুলো চারদিকে, একদিকে ব্যাগ, আকাশে শরতের মেঘ, আশেপাশে মানুষের চীৎকার সব শুনতে পেয়েছিলেন, দেখতে পেয়েছিলেন কিছুক্ষণের জন্য।

মানুষ ভাবে এক, আর হয় এক।

মারা যাওয়ার পর বাড়িটা একা হয়ে গেল। মেয়ে এলো। পারলৌকিক কাজ করে জমির দলিল নিয়ে দৌড়াদৌড়ি শুরু করল। বিক্রি করতে হবে। যত তাড়াতাড়ি বিক্রি হয়ে তত শান্তি।

জ্যোৎস্না ছাদেই বসে থাকে। ঘরে নামে না আর। ঘর বলে কিছু হয় না। যতদিন মন থাকে ততদিন ঘর, সংসার। এখন কিছু নেই। এখন একদলা কষ্ট। অপূর্ণতার কষ্ট।

যেদিন প্রচণ্ড বৃষ্টি হল। সোদপুর প্রায় জলে ডুবে যায়। সেদিন একবার নেমেছিলেন। তাও রান্নাঘর না, শোয়ার ঘর না, শুধুমাত্র একবার বাথরুমটা দেখবেন বলে। আধকৌটো শ্যাম্পু, একটা ক্ষয়ে যাওয়া সাবান, লাল কানাভাঙা বালতি যে জীবনের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া এত এত মানুষের থেকে এত কাছের.... কে জানত?

বাথরুমে এসে বসলেন মেঝেতে। মায়ের কথা মনে পড়ল। কান্না পেল। এই জগতটা বড্ড গুমোট। সব জগতই আসলে নিজের মনের বানানো জগত। এ জগতটাও মনের গুমোটে গুমোট হয়ে আছে। ছাড়াবেন কী দিয়ে? ছাড়িয়ে দিলেই কি আর যাবে? এক বালতি জল এখনও ভরা। কে ভরল? নাকি ভরাই ছিল। মেয়ে তো আসে না আর। বাড়ি বিক্রি হবে। উপযুক্ত দাম পায় কই?

রাত ক'টা মনে নেই। জ্যোৎস্না দেখল শয়ে শয়ে মেয়ে যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে। হাতে মোমবাতি। এত রাতে এত মেয়ে কেন?

হঠাৎ চমক ভাঙল। চারদিকে আনাচে-কানাচেতে অসংখ্য তার মত মাটির জগত ছাড়া শরীর। যে শরীরে ঘাম নেই, ক্লেদ জমে অনেক। তারা নিঃশব্দে অন্ধকার বেয়ে নামছে। মিশে যাচ্ছে ওই মোমবাতি হাতে মেয়েদের স্রোতে। তাদের না-শরীরের উপর রাখা মুখে পড়ছে মোমবাতির আলো, তাদের না-চোখ উঠছে জ্বলজ্বল করে।

জ্যোৎস্না জিজ্ঞাসা করল, তোমরা?

দু একজন ফিরে তাকালো। অন্ধকারের আভূষণ সরিয়ে দেখালো ক্ষতবিক্ষত শরীর। খুবলে খেয়েছে যেন কারা। ওরা কারা? ওই শিশুরাও? থাক থাক। কিচ্ছু দেখাতে হবে না। আমি জানি। এ বাড়ির দেওয়াল জানে। বাথরুম জানে। আদালত জানে না শুধু। আদালতে সব বিচার হয় না।

কয়েকজন মেয়ে একটা গভীর অন্ধকারকে আড়াল করে নিয়ে যাচ্ছে। সে অন্ধকারের ভিতর থেকে আসছে ফুঁপিয়ে কান্না। গোঙানির মত।

জ্যোৎস্না জিজ্ঞাসা করতে গেল..... কে ও.....

জিজ্ঞাসা করার সাহস পেল না। ও গোঙানির স্বর এত চেনা....একজন তবু তার বিস্ফারিত চোখের কোটরের দিকে তাকিয়ে বলল.... ও-ই তো... .সদ্য এসেছে..... তুমি আসবে না? হাঁটবে না রাতে?

জ্যোৎস্না নামল রাস্তায়। চারদিকে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে যেন এককালের পাহারা দেওয়া চোখেরা। তারা বলছে না, যাও। আবার বলতেও পারছে না, এত রাতে তোমরা কেন?

জ্যোৎস্নার মনে হল গোটা বাথরুমটা তার হাত ধরে হাঁটছে আজ। আধখানা শ্যাম্পুর প্যাকেট, ক্ষয়ে যাওয়া সাবান, কানাভাঙা বালতি....সবাই হাঁটছে। বলছে আমরা সাক্ষী.... সব বলে দেব আজ.... সব সব সব....