গুরু বললেন, "ঈশ্বরলাভ করতে কাম ত্যাগ করো"
শিষ্যের কামঘরে পড়ল তালা। তিলে তিলে জমে উঠছে বিষ। বাইরে ধূপধুনো চন্দনের গন্ধ। আরতির কাঁসরের আওয়াজ, পঞ্চপ্রদীপের শিখার তাপ। দিনে দিনে তালাতে পড়ল জং।
কামঘরের দেওয়ালে ধরল চিড়। একটা চিড়, দুটো চিড়, তিনটে চিড়....এক হাজারটা চিড়...এক লক্ষ চিড়...যে কোনো সময়েই ঘরটা পড়বে ধ্বসে। শিষ্য জপের সংখ্যা বাড়ায়, ধ্যানের সময় বাড়ায়, নিত্যনতুন পদ্ধতি অভ্যাস করে। তবু কামঘরের দেওয়ালে বাড়ে চিড়। পুঞ্জ পুঞ্জ ড্যালা ড্যালা কামকীট দেওয়ালের চিড় দিয়ে বাইরে আসছে। কটা মারবে? একাদশী, পূর্ণিমা, সংক্রান্তি কিচ্ছু মানছে না কীটের দল। ঘরের ভিতর বিষাক্ত বাতাসে শ্বাস নেওয়া দায়। যেন যে কোনো সময়েই ঘটবে অঘটন - যেমন ভূমিকম্প! হলেন গুরুর শরণাগত।
গুরু বললেন, কামুক! দূর হও! গতজন্মের কর্মফল, পাষণ্ড!
শিষ্য প্রাণ ত্যাগ করবে। আত্মায় লিঙ্গ নেই। আত্মাকে মুক্তি দেবে। শিষ্য ঘাটের কাছে এসে দাঁড়াল। অদূরে দাঁড়িয়ে এক রমণী। বারাঙ্গনা। বহুবার মন্দিরে পূজো দিতে ওর ছায়া থেকে বাঁচিয়ে চলেছে নৈবেদ্যর ডালা। মনে হয়েছে এমন নরকের কীটের কি প্রয়োজন দেহধারণের? অযথা বিশ্বনাথের সংসারকে কলুষিত করা! কেন, নদীতে কি জল কম হয়েছে? দড়ির কি অভাব? না বাজারে ওই পাপী দেহ ছাড়ার মত বিষের অভাব ঘটেছে?
শিষ্য ধীরে ধীরে রমণীর কাছে এসে দাঁড়াল। রমণী মুখ তুলে চাইল। তখন সন্ধ্যে, মন্দিরে আরতির ঘন্টা কানে আসছে।
শিষ্য বলল, তোমার ঘর কতদূর?
রমণী আঙুল তুলে দেখাল, নদীর পশ্চিমপাড়। বেশ্যাপট্টি। শিষ্য চেনে। এতদিন সংসারে ওই স্থানটার কোনো অস্তিত্ব ছিল না। আজ সংসারের কোনো অস্তিত্ব নেই তার সামনে। সে রমণীর হাত ধরে বলল, চলো।
নৌকায় উঠল তারা। পুবপাড় থেকে নৌকা ছাড়ল পশ্চিমপাড়ের দিকে। শিষ্য বসল নৌকার পাটাতনে। হাত রাখল সে রমণীর হাতে। নৌকার দাঁড় বাওয়া, জলের ছলাৎছলাৎ শব্দ, সন্ধ্যের আকাশে পাখিদের ঘরে ফেরার দল, সবই কেমন জীবন্ত। পবিত্রতার চেয়ে প্রাণবন্ত। দীর্ঘশ্বাস নিল। নদীর পাড়ে রাখা বিবর্ণ, খড়-কাঠ বেরোনো দেব-দেবীদের মূর্তির সারি। প্রাণহীন। বিসর্জনের অপেক্ষায়। শিষ্যর করুণা হল। দেবতার উপর, গুরুর উপর, নিজের অতীতের উপর।
নৌকা পাড়ে এলো। পশ্চিমপাড়। রমণী হাত ধরে বলল, এদিকে।
শিষ্য বলল, দাঁড়াও। সে নদীর তীরে রমণীকে আলিঙ্গন করে নিজের ঠোঁটকে তার ঠোঁটের উপর রাখল। যেন তরী এসে তীরের মাটি ছুঁল।
চিড়গুলো একে একে যুক্ত হয়ে সবকটা দেওয়াল ভেঙে পড়ল। ভিতরের সব অন্ধকার অসীম অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। প্রাণের গভীরে তীব্র যন্ত্রণার সাথে এক অতি বাস্তব আনন্দ তাকে ঘিরে নিতে লাগল। একটা স্নিগ্ধ বিশ্বাস জন্মালো। কার উপর সে জানে না, তবু জন্মালো। আকাশ ভরতি তারা, নদীর জলের আওয়াজ মিলে তার সামনে এসে দাঁড়াল আবছা একটা মূর্তি। সে জিজ্ঞাসা করল, কে তুমি?
ছায়ামূর্তি বলল, তোমার পবিত্রতা!
শিষ্য বলল, যাও।
ছায়ামূর্তি বলল, অমরত্ব চাও না? ঈশ্বরদর্শন?
শিষ্য বলল, না।
তার চারদিক নিস্তব্ধ। ঝিঁঝিঁর ডাকে, তারার আলোয় সে রমণী তাকে হাত ধরে নিয়ে চলল তার ঘরে। শিষ্যের আত্মা শরীর পেল।