জবা বসে আছে গঙ্গার পাড়ে, শেষ সিঁড়িতে। পা ডুবে আছে জলে। পাশে বসে মহেশ, বেহালা বাজাচ্ছে। রাগ বলে একে। জবা বোঝে না। হাল্কা লাগে।
একটু দূরে ঈশ্বরগুপ্ত সেতু। এত রাতে এত গাড়ি কোথায় যায়?
জবা'র মাঝে মাঝে মনে পড়ে না সে বেঁচে আছে। একটা জ্বর জ্বর ভাব শরীরে মনে সব সময়। থার্মোমিটারে ধরা পড়ে না। সুবল ডাক্তার বলে, মনে রোগ।
=======
রাত কত হল জানো?
মহেশ জিজ্ঞাসা করল।
বেহালা কখন থামালো? জবা মাঝে মাঝে এত অন্যমনস্ক হয়ে যায়!
গঙ্গার ওপারে কোথাও কীর্তন হচ্ছে। ভীষণ বেসুরো। জবা বলল, ক'টা বাজে গো?
দুটো।
জবা বলল, বসব। যাব না। তুমি যাও। সকাল থেকে আবার তো…..
এত রাতে ভিক্ষা করো... বলতে ইচ্ছা করল না। মহেশের পা নেই দুটো। পোলিও। বাজারে কোনো কোনো জায়গায় বসে বাজায়।
জবা ইটভাটায় কাজ করে। অনেক কাজ, যার কিছু না করলেও হয়। দু'জনের মিল, কেউ নেই সাতকুলে।
মহেশ বলল, আমরা কেন বেঁচে আছি বল তো?
জবা বলল, মরছি না তাই।
মহেশ বলল, নৌকায় চড়বি? ওই দেখ…
জবা ভাবল একটু। বলল, আমার হাতটা ধরো।
জবা প্রথমে মহেশকে নৌকায় তুলল। তারপর বেহালাটা নিয়ে এলো সিঁড়ি থেকে।
নৌকার দড়ি খুলল। যতীনের নৌকা।
=======
জবাই দাঁড় বাইল। মহেশ হাল ধরে থাকল। মাঝগঙ্গায় এনে দাঁড় করালো। এখন জোয়ার। যায় যেদিকে যাক।
মহেশ বলল, বাজাই?
জবা বলল, বাজাও।
মহেশ বলল, এটাকে বলে জয়জয়ন্তী। শোন।
=======
চাঁদ জলে সাঁতার কাটছে। নৌকা ভেসে যাচ্ছে ব্রীজের দিকে। ঈশ্বরগুপ্ত সেতু।
মহেশ কাঁদছে। এমন হয়। আগেও হয়েছে। জবা চুপ করে। শুয়ে আছে। চিৎ হয়ে। তারারা একে একে তাকে চিনছে, সবাই। তার নাম জিজ্ঞাসা করছে।
হঠাৎ মহেশ চীৎকার করে উঠল, জবা!!
জবা দেখল, একটা মৃতদেহ। মহিলার। পেটটা ফোলা। জলে। ভিজে নীল শাড়ির উপর চাঁদের ছায়া পড়েছে। চাঁদ জল ছেড়ে ওর পেটে উঠল কখন?
মহেশ বলল, ও কি পোয়াতি জবা?
জবা বলল, আমি তুমি সবাই পোয়াতি দাদা….. মৃত সন্তান প্রসব করছি রোজ…. আমিও কাঁদি না… বাচ্চাগুলোও না….
তুই পাষাণ হয়ে গেছিস জবা….
মৃতদেহটা দূরে চলে যাচ্ছে। পচা গন্ধ আসছে। মানুষের আত্মা চলে গেলে পচা গন্ধ বেরোয়। আর হৃদয় মরে গেলে?
=======
দু'জনেই চুপ। নৌকাটা ভাসতে ভাসতে ব্রীজের তলায় চলে এসেছে।
মহেশ বলল, ফেরা নৌকা জবা…. ভোর হয়ে যাবে…. একটু না শুলে…..
জবা বলল, না… ঝাঁপ দেবে? তোমার মরতে বেশি সময় লাগবে না দাদা… আমার একটু সময় লাগবে…. শরীরটা বাঁচতে চাইবে…. রঞ্জনের দোকানে দেখ না, মুরগীটার গলা কেটে যখন ড্রেনে ধরে, সব রক্ত বের করে দেওয়ার জন্য, মাল তখনও ডানা ঝাপটায়…ঝাঁপ দেবে?
=======
মহেশকে সিঁড়িতে বসিয়ে, হাতে বেহালাটা দিয়ে বলল, যাও…..
মহেশ বলল, তুই?
জবা বলল, প্রকাশের ওখানে যাব…. মাল লাগবে…. গলা শুকিয়ে যাচ্ছে….
মহেশ ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে বেহালাটা হাতে নিয়ে বাড়ির দিকে যাচ্ছে……
মহেশ কয়েকবার অপরাধীর মত জিজ্ঞাসা করেছে, কেন পারলাম না জবা? কেন?
জবা উত্তর দেয়নি। উত্তর জানে না তা নয়। তবে সব উত্তর দেওয়া যায় না। বাঁচার এমন কিছু নেই…. স্বপ্ন নেই যে মরে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে হবে।
(ছবি - ইন্টারনেট)