গঙ্গার পাড়ের সিঁড়ি। জলের ধাক্কায় ধাক্কায় তাকে টেনে নামাতে চায় গঙ্গায়। বারবার ধাক্কা দিয়ে বলে, আসো না.... কী গো... আসো.... এই দেখো তোমায় ডুবিয়ে দিয়েছি.... এই দেখো তুমি আমার বুকের মধ্যে ডুবে কেমন.... এসো না... এসো.... চলো আমার সঙ্গে..... যাই সমুদ্রে।
জল তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চায় সমুদ্রে। কিন্তু পাড়ের বাঁধন ছেড়ে নামতে পারে না। তার বুকের উপর দিয়ে লোকে জলে নামে ওঠে। তাদের গা ভেজা জলে সারা শরীর ভিজে যায়। তার ঈর্ষা হয়। রাগ হয়। ক্ষোভ হয়। কিন্তু নামবে কী করে? যাবে কী কর ভেসে? তার ওজন আছে না? তার আছে না ডাঙার সঙ্গে পিছুটান!
সেদিন অনেক রাত। সদ্য তার গা থেকে নেমেছে গঙ্গা। এখনও ভিজে গা। চাঁদের আলোয় চকচক করছে তার শরীর। চাঁদের ভাসা ছবি গঙ্গার বুকে দুলতে দুলতে তার গায়ে এসে ঠেকছে.....গঙ্গা বলছে....চলো....চলো....চাঁদ বলছে এতো কীসের গুমোর তোর....কেউ নেই কোনোদিকে..... আয় আয়.....চল...আমিও যাব সাথে। ভয় নেই।
বুকটা দুরদুর করে ওঠে। ভয় পায়। কোথায় যেন পেঁচা ডেকে উঠল। কোথায় যেন একটা ঘেয়ো কুকুর তার বুকের উপর এসে মলমূত্র ত্যাগ করে গেল। গঙ্গা সব ধুয়ে নেয়। তবু লজ্জা তো করে।
গেল জৈষ্ঠে। কী গরম। কী গরম। জল আসে না কাছে। তার বুক পুড়ে খাঁ খাঁ করছে। যেন ফেটে যাবে এখনই।
অভিমানী মন তার তাকালো বয়ে যাওয়া গঙ্গার দিকে। একেবারেই কি ভুলে গেছে? যেখানে অধিকার নেই, সেখানে অভিমান এক বিড়ম্বনা। নিজের উপর আক্রোশ।
হঠাৎ একটা পানকৌড়ি সারাটা গা ভিজিয়ে এসে বসল তার বুকে। তার গায়ের থেকে বিন্দু বিন্দু জলের ফোঁটা পড়তে লাগল তার বুকে। পাখির পায়ের নখ ভেজা জল, আঁচড়ের সঙ্গে দিল জলের সুখ।
ভোলেনি তবে। সমুদ্রে না যাক। বা ভাসুক জলে। কিন্তু এই ডাকটা থাক। সংসারে কেউ তো ডাকে।
=======
একদিন সিঁড়িতে চিড় ধরল। ভাঙন ধরল বুকে। কিন্তু এ ভাঙনেও যেন কী সুখ! যেখানে যেখানে চিড় ধরে, সেখানে সেখানে আসে জল। ভরে গঙ্গা। বলে, কষ্ট হচ্ছে না!
সে বলে না কিছু! কষ্ট তো হচ্ছেই। খুব খুব কষ্ট।
একদিন হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল সে। এক তরুণের পায়ের চাপে। সে তরুণ তার বুকে লাথি মেরে বলল, শালা!
পাঁকে আটকে দিয়েছিল সে তরুণকে গঙ্গা। মুখ থুবড়ে পড়েছিল। পা কেটেছিল, হাত কেটেছিল, মুখ কেটেছিল শামুকে, ভাঙা মাটির পাত্রের কানায়। তরুণ অবশেষে বলেছিল, উফ!
ভাঙা সিঁড়ি টুকরো টুকরো হয়ে মিশতে লাগল গঙ্গায়। প্রতিটা টুকরোকে আদর করে নিতে নিতে গঙ্গা বলল, ভেবো না….সব জুড়িয়ে নেব আমি……
সে বলল, জুড়িও না….ভার হবে….বরং আরো ভেঙে মিশিয়ে নাও পারো যদি……সমুদ্রে চলো…..
গঙ্গা বলল, বেশ।
=========
তখন মিস্ত্রি গঙ্গার পাড়ে বানাচ্ছে আরেকটা সিঁড়ি। অবাধ্য জমাট বাঁধা মশলা বারবার ধুয়ে যাচ্ছে গঙ্গায়। শুকাতে চায় না সে। জুড়তে চায় না। ওতে ভার বাড়ে।
ভার বাড়লে সমুদ্রে যাওয়া হয় না। কিন্তু সংসার বলছে, জমাট বাঁধো…নইলে আমার কাজ চলে না।
একদিন রাতে, তার জলে ভেজা গায়ে এসে পড়ল অমাবস্যার অন্ধকার মাখা তারার আলো। তাকে তারা ফিসফিস করে বলে চলল আগের সিঁড়ির গল্প।
সে বলল, ছুটি মেলে তবে?
বয়ে যাওয়া জল বলল, অবশ্যই…. অবশ্যই।