সৌরভ ভট্টাচার্য
9 July 2020
সামনে দীর্ঘ সিঁড়িক্রম। আমি একদম প্রথম সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে। ভাবছি উঠলেও হয়, আবার না উঠলেও হয়। আনুমানিক পাঁচশোটা সিঁড়ি। উঠলে শুনেছি মনোরম নৈসর্গিক দৃশ্য। কি করব? উঠে যাব? কিন্তু এইখানেই বা কি কম সৌন্দর্য। ভালোই তো। কিন্তু অনেকেই তো উঠে যাচ্ছে। আমি উঠব না? কিন্তু যারা নেমে আসছে? তারা কি আমাকে লুজার ভাবছে? ওদের সুখ কি গভীর? এই যে চায়ের দোকান, চারিদিকে ছোটো-ছোটো টিলা। কেমন অদ্ভুত সবুজ - একি কম! গাড়িতে এসেছি এতটা? হ্যাঁ এসেছি। ওই তো গাড়িটা পার্ক করা। আমরা চোদ্দোজন এসেছি। তেমন কেউ কাউকে চিনিনা, একটা ট্রাভেলস গ্রুপের সাথে এসেছি।
ওই তো আমাদের গ্রুপের চারজন উঠছেন না, চা খাচ্ছেন। ওনারা যাবেন না? ওনাদের কি কেউ লুজার বলবে না? আরে ধুর! ওদের তো হাঁটু ব্যথা.. তার উপর কার একটা যেন পেসমেকার....ভ্যালিড এক্সকিউজ... আমি?....
পঞ্চাশটা সিঁড়ি উঠে গেলাম। কেন উঠছি? আমি কি সত্যিই উঠতে চাইছি? কখন উঠলাম? কিসের জোরে উঠলাম? না, আমার কোনো রোগ নেই আপাতত, বয়েসও হয়নি তেমন.. কিন্তু আমি কি সত্যিই উঠতে চাইছিলাম... চাইছিলাম না তো... আমার ঘাম হচ্ছে... শ্বাসটা অল্প দ্রুত হচ্ছে.... দুশোটা সিঁড়ি উঠে এলাম... আমার পাশ দিয়ে যারা যাচ্ছে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে.... নাকি আমার মনে হচ্ছে..... আমি দল বদল করেছি নাকি রঙ? আমি উঠতে চাইছিলাম না... তাও উঠছি... অর্থাৎ আমি এখন অ্যাচিভারদের দলে নাম লিখিয়েছি.... ওরাও উঠছে, আমিও উঠছি.... প্রচণ্ড ঘাম হচ্ছে... তিনশোটা সিঁড়ি.... ওই দূরে চায়ের দোকানটা দেখা যাচ্ছে.... দোকানে বসা কয়েকজন অক্ষম মানুষ... লুজার... যাদের এই পৃথিবী নিংড়ে রস বার করার শক্তি নেই আর... আমি উঠছি... যারা উঠে নেমে আসছে তাদের চোখে আমার জন্য অভিবাদন? নাকি ঈর্ষা? তারা কি সংখ্যায় বেড়ে যাচ্ছে? ঈর্ষা সংখ্যার বৃদ্ধি চায় না... করুণা করতে চায়... করুণা ঈশ্বরের স্বভাব... আমিও ঈশ্বর হতে চাই... অমরত্ব চাই... আমার সন্তানে, আমার কীর্তিতে... সাড়ে চারশো.... আমি পারছি....
চায়ের দোকানটা আর দেখা যাচ্ছে না.... আমি বসে... বিশ্রাম দরকার... বুকটা হাপরের মত লাফাচ্ছে.... জামা-প্যান্ট ভিজে চাপচাপ... আমি প্রায় অ্যাচিভার.... আর পঞ্চাশটা সিঁড়ি... আচ্ছা আমি যদি না উঠি আর? এখনই যদি নেমে যাই.... আমি কি তবে? ব্যতিক্রম.... আমায় নিয়ে কথা হবে... নাকি বলবে আর দম ছিল না.... কি বলবে? কিন্তু আমি তো জানি আমি পারতাম উঠতে আরো পঞ্চাশটা.... এমন কিছুই নয়..... আমি এও জানি যে আমি উঠতে চাইনি... আমার ওই প্রথম সিঁড়ি শুরুর আগেই মন ভরে গিয়েছিল চারপাশ দেখে... আমার বাড়ি কলকাতার এঁদো গলিতে.... বারোমাস বৃষ্টির জল জমে... সেইখানে এই পাহাড়, এই খোলা আকাশ আর এই পাঁচশো সিঁড়ির উপরে ওঠার কি পার্থক্য? একি নেশা?
না উঠতেই হবে... আমি কি চাই বড় কথা না... আমার মাথায় এলোমেলো চিন্তা... #&@*..... °$_£=£℅££×..... এগুলোর আদতে কোনো মানে নেই...
কয়েকটা ছাগল.... ওই তো ঘাস খাচ্ছে বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে.... পাহাড়ের ঢালে দাঁড়িয়ে.... কি ব্যালেন্স... আমি পারব? না থাক..., এই তো আমি ভিউ পয়েন্টে.... বড় রেস্টুরেন্ট... ঘমার্ক্ত আত্মগর্বী মানুষদের আগ্রাসী বুভুক্ষা.... ওই তো বিস্ফারিত চোখে একে অন্যকে মেপে নেওয়া... কে কতটা ক্লান্ত... ঘায়েল... কেউ বসে বসে হাঁপালে... তার দিকে আত্মতৃপ্ত দৃষ্টিপাত... কখনও রক্তিম করুণ....
সামনে রেলিং... নীচে খাদ... ওই যে চায়ের দোকান.... সেই একই দৃশ্য.... আমি উঁচু থেকে দেখছি.... দূরে পাহাড়ি শহরটা স্পষ্ট... খেলনার মত... মানুষ নিজের সৃষ্টিকে দূর থেকে দেখতে ভালোবাসে... তাকে খেলনা ভাবতেও ভালোবাসে.... ওগুলো আমাদের বাড়ি নয়... এ পাহাড়... এ শহর.... এ সব কিছু তোমাদের... আমরা পর্যটক... আমরা প্রত্যেকে এখানে বাড়ি করার আশা রাখি... আমরা প্রত্যেকে মনে মনে তোমাদের প্রতিবেশী হতে চাই.... ভুল বললাম, তোমাদের প্রাচুর্যহীন সাদামাটা শ্রমবহুল জীবনের প্রতিবেশী না... তোমাদের এই ঐশ্বরিক নিসর্গের প্রতিবেশী... আমরা যা টাকার বিনিময়ে পাই... তাই টাকা ছাড়া পেতে চাই... কিন্তু আমরা কেউ থাকি না.... আমরা সমতলে নেমে গেলে আর খোঁজ রাখি না তোমাদের... তোমাদের রাজনীতি... তোমাদের স্বাস্থ্য, তোমাদের শিক্ষা ইত্যাদি নিয়ে আমাদের কোনো ভাবনা নেই.. কেন এই চৌহদ্দির মধ্যে একটা ব্যাঙ্ক নেই যা রোজ খোলে, একটা স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই... কেন স্কুলে যেতে এতটা দুর্গম পথ পাড়ি দিতে হয় আমাদের কোনো ভাবনা নেই... আমরা চাই আমাদের কারেন্ট দাও... আমরা ফোন, ক্যামেরা চার্জে বসাব... আমাদের শুদ্ধ পানীয় দাও... আমাদের সুস্বাদু খাবার দাও.. আমরা পয়সা দেব... তোমরা রোজ রোজ এমন সূর্যোদয় দেখো, এমন ঝর্ণায় স্নান করো... এমন শোভা দেখো... আমরা পাই? না তো। আমাদের তাই চূড়ান্ত আবেগ তোমাদের বাসস্থান নিয়ে... আমাদের অসম্ভব রোম্যান্টিকতা তোমাদের সব কিছু নিয়ে.... আমরাই আসল... আমাদের সমতলে...,
ঘাম শুকিয়েছে... আমার শীত করছে... আমায় নামতে হবে... কিন্তু আমার সারা শরীর জুড়ে বিষন্নতা... অবসাদ... আমি যেন আমার কাছেই হেরে গেলাম... সবার কাছে জিতে.... আমার নামতে নামতে পা টাটাচ্ছে... মন কামড়াচ্ছে... চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে ক্লান্তিতে...
আমি নেমে এলাম.... আলাদা কিছু মনে হয়নি.... আমি তবু মুখে হাসিটা ধরে রেখেছি কপট তৃপ্তির হাসি.... লুজারেরা আগেই বাসে উঠে বসে আছে... হয় তো নিজেদের পুরোনো দিনের অ্যাচিভমেন্ট মনে করছে... হয় তো নানা যুক্তি দিয়ে লজ্জাটাকে ঢাকছে... আমাদের ট্যুর গাইড আমাদের পরের গন্তব্যের বর্ণনা দিচ্ছে... আবার মাংসপেশি শক্ত করার চ্যালেঞ্জ... এবার নাকি অনেকটা নীচে ঝর্ণা.. অ্যাডভেঞ্চার....
সত্যিই কি এই শহুরে মানুষগুলো শহরের এক একটা গর্তে ঢুকে আর এই অ্যাডভেঞ্চারের কথা ভাবে? আমাদের আচার আচরণে সেই ঈর্ষা... সঙ্কীর্ণতা... আরামপ্রিয়তা... থাকে না? আমরা কারা তবে? অ্যাডভেঞ্চার বিলাসী, না কি একঘেয়েমির থেকে পরিত্রাণ পেতে মরিয়া কিছু বোরিং মানুষ....?