রীতা ভাঙা পাল্লাটা ঠেলে ঢুকতেই হিসির গন্ধ পেল। নীলা উপুড় হয়ে শুয়ে। নাইটিটা হাঁটুর উপর উঠে। একটা হাতে গ্লাস ধরা ছিল, উলটে পড়ে আছে যেটা মেঝেতে, আরেকটা হাত মেঝের উপর রাখা, উপুড় করে। কোমরের নীচ থেকে হিসি গড়িয়ে সিংহাসনের দিকে চলে গেছে। শুকিয়ে গেছে, দাগ হয়ে আছে।
নীলা মারা গেছে। রীতা বসে সোজা করে শোয়ালো নীলাকে। তার মাসির মেয়ে। দুজনেই ষাট ছুঁয়েছে। একই বস্তিতে থাকে। নীলার বর, ছেলে সব মরেছে। রীতার আছে।
নীলা সোজা তাকালো টালির ছাদের দিকে। রীতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বসে থাকল কিছুক্ষণ। মেঝেতে বসতে কোমরটা টাটায়। খানিকবাদে উঠে, কচি ডাক্তারকে ডাকতে গেল। যাওয়ার আগে ঝুঁকে নাইটিটা পা অবধি টেনে দিল নীলার।
=====
কচি ডাক্তার সবে তার দোকান খুলে বসেছে। বাইরে লাল কালিতে লেখা, ডাক্তারখানা। ভিতরে ঢুকে জানলাটা খুলে মাঠের দিকে, ধূপ জ্বালিয়ে গণেশ লক্ষীকে দেখিয়ে, চেয়ারে বসেছে, নিয়মমাফিক বাবুর চায়ের দোকান থেকে চা দিয়ে গেল কাঁচের গ্লাসে খগা। খগা বোবা।
রীতা ঢুকল। চেয়ারে বসে কাঁধে ফেলা গামছাটা দিয়ে কপাল মুছতে মুছতে বলল, চলুন… মনে হয় দিদি…..
রীতার গলা বুজে এলো। অপ্রস্তুত লাগল। এতক্ষণ তো কান্না পায়নি।
কচি চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, রবিবারের বাজার, আজ একটু গরম, তুমি যাও, আমি আসছি। তবে সার্টিফিকেট তো আমি দিতে পারব না। তোমায় হয় সুশীল ডাক্তারকে ডাকতে হবে, ভিজিট পাঁচশো টাকা, নইলে হাস্পাতালে নিয়ে যেতে হবে।
রীতা জানলার বাইরে তাকালো। এগুলো তো ভাবেনি। পাঁচশো টাকা কোথায় পাবে?
"আচ্ছা" বলে উঠে গেল। গামছাটা কাঁধ থেকে মেঝেতে পড়ল। খেয়াল করল না। কচি দেখেও কিছু বলল না। এইট পাশ ডাক্তার বলে এ বস্তিতে কেউ কেউ খোঁচা দেয়। রীতা তাদের মধ্যে একজন। মরুক গে।
======
নীলার সারা ঘর কুড়িয়ে দুশো টাকার বেশি পাওয়া গেল না। জানত রীতা। পটলকে বলে এসেছে ভ্যান আনতে। হাস্পাতালে নিয়ে যাবে।
নীলার বালিশের নীচে শনি ঠাকুরের ছবি। রীতা অবাক হল না। মায়া লাগল। দিদির কপালে হাতটা রেখে বসল। ঠাণ্ডা কপাল।
দিদি প্রতি শনিবার প্লাস্টিকের গ্লাস নিয়ে বস্তির শনি মন্দিরে বসে থাকত। পুজো শেষ হলেই গ্লাস টইটম্বুর করে সিন্নি নিয়ে আসত। কপাল ভালো থাকলে দুই গ্লাসও পেত। গতকাল পেয়েছিল।
একবার দুই গ্লাস সিন্নি নিয়ে বাড়ির সামনে বসেছে, তার ভীষণ জোরে পায়খানা পেয়েছে। রীতাকে বসতে বলে দৌড়ালো। এদিকে রীতাও নাতি ডাকছে বলে নীলার বাড়ির সামনেই দুই গ্লাস সিন্নি রেখে বাড়ি চলে এলো। নাতি পেন্সিল খুঁজে পাচ্ছিল না। খুঁজে পেতে সময় লাগল। তার ছেলের বউ আলমারির মধ্যে তুলে রেখেছিল, নাতি পেন্সিল চিবিয়ে নষ্ট করে বলে।
ফিরে এসে দেখে নীলা একটা বড় আরশোলা সিন্নির গ্লাস থেকে বার করছে। রীতা মুখটা বেঁকিয়ে বলল, এ ম্যাগো…. খাস না দিদি…..
নীলা হেসেছিল। কি যে করুণ হাসি। তারপর চুমুক দিয়ে গোটা গ্লাসের সিন্নিটা খেল। খেয়ে হাসল। বলল, মরব না। ভয় খাস না।
গতকালও দু গ্লাস সিন্নি খেয়েছে। শনিবার দুগ্লাস সিন্নি খেলে রাতে আর কিছু খেত না।
রীতা মাথার কাছে বসে দেখল ঘাড়ের কাছ থেকে কানের দুপাশটা লাল টকটকে হয়ে আছে। রক্ত নিশ্চয়। মাথার ভিতর শিরা ছিঁড়েছে। দিদি তার থেকে ফর্সাই ছিল। সারাদিন রোদে ঘুরে ঘুরে রঙটা পুড়েছিল।
=======
ভ্যান এলো। বস্তির অনেকে জড়ো হয়েছে। নীলাকে ধরে শোয়ানো হল। একটা মাদুর পাতা হল। গায়ে চাদর।
ভ্যান চলল। বস্তির শনি মন্দিরটা পেরোচ্ছে। রীতা বলল, দাঁড়া তো রে।
নেমে মন্দিরে গেল। ঠাকুরের পায়ের থেকে একটা অপারিজতা ফুল তুলে নিয়ে এসে দিদির কপালে, ঠোঁটে ছোঁয়ালো। বলল, আয় দিদি, আয়।
ঠাকুরের দিকে তাকিয়ে বলল, একটু দেখে রেখো। আর মেয়েমানুষ করে পাঠিও না। পারলে গরুছাগল করে পাঠিও।