Skip to main content

শিক্ষক আর সংস্কারকের মধ্যে পার্থক্য আছে। আমাদের দুই প্রয়োজন আছে। আগের যুগে মহাপুরুষের উদ্যোগে সংস্কার হত, এখন রাজনীতির নেতামন্ত্রীদের মাধ্যমে সংস্কার হচ্ছে। যে দল যে নীতিতে বিশ্বাসী সেই শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। সিলেবাস বদলে যাচ্ছে, লাইব্রেরীতে বইয়ের ধারা বদলে যাচ্ছে, শিক্ষকদের শিক্ষার সুর বদলে বদলে যাচ্ছে। সবই নির্ভর করছে দলগত ভাবের উপর।
      বর্তমানে শিক্ষক দুই ধারার। এক, ফার্স্টপার্টি সফটওয়ার অর্থাৎ স্কুল শিক্ষক। দুই থার্ডপার্টি সফটওয়ার অর্থাৎ গৃহশিক্ষক, কোচিংক্লাস, মকটেস্ট কেন্দ্র ইত্যাদি ইত্যাদি। যখন প্রগ্রেসিভ চশমার জন্য দোকানে যাবেন, তখন আপনাকে বলা হবে, যত বেশি টাকা দেবেন তত আপনার লেন্সের করিডোর বাড়বে, অর্থাৎ দেখার জায়গাটা বিস্তৃত হবে। এও তেমন। যত বেশি টাকা ঢালা যাবে তত উঁচুতে ওঠার সিঁড়ি ফাঁকা পাওয়া যাবে। মেধার কথা আছে অবশ্যই, তবে তা প্রথম শর্ত নয়। যে দেশে মেধা রিজারভেশানের চক্করে কম্প্রোমাইজড হওয়ার স্পর্ধা দেখায় সে দেশে মেধার স্বীকৃতি বা সম্মান কতটা বোঝাই যাচ্ছে। মিডিয়া রাণু মণ্ডল বোঝে, মিডিয়া বনধ হরতাল, বোমাবারুদ, গোলাগুলি, গণপ্রহারে হত্যা বোঝে, কিন্তু মিডিয়া ফুটেজহীন প্রশ্ন করে না। গভীরে গিয়ে রোগের কারণ অন্বেষণ করে না। সমীক্ষা নেয় না। সে ব্যস্ত ব্রেকিং নিউজে। অর্থাৎ আগুন লাগার পর তাদের ভূমিকা, আগুন লাগার আগে বারুদের জোগান হচ্ছে যেখানে নিঃশব্দে সেখানে সে ঠুলি পরে। কারণ অত সূক্ষ্ম বিচার পাবলিক খায় না। জনসাধারণ বোঝে না। মিডিয়াকে বোঝানো যায় না যে, ডেঙ্গুর মশার জন্মনিরোধও প্রচার করতে হয়, জনচেতনা গড়ে তোলার পিছনে তাদের দায় আছেই, সে দায় ডেঙ্গুতে কতজন মারা গেছে, কিভাবে মারা গেছে এই রিপোর্টেই তা শেষ হয় না।
      মিডিয়া থাক। শিক্ষকতায় আসি। তো কথা হচ্ছে এই দুই ধরণের শিক্ষা ব্যবস্থার উপর আমাদের প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা দাঁড়িয়ে। আবারও বলি শিক্ষক মানে সংস্কারক নয়। আগে ছিল, এখন নেই। এখন দুপক্ষই সচেতন। আগে দেখেছি গরীব বলে যদি আপনি কারোর টাকা কম নিতেন বা নিতেন না, তখন সে মন দিয়ে পড়ত, বা কোথাও শ্রদ্ধা থাকত। এখন আপনি যদি টাকা না নেন তবে আপনার কাছে ফ্রিতে পড়ে আরেকজনের কাছে টাকা দিয়ে পড়ে নেবে একই সাবজেক্ট। কারণ আমাদের হিসাব - যত শিক্ষকের সংখ্যা বাড়বে তত শিক্ষা সাইসাই করে দৌড়াবে। “তোমার পিছনে কতগুলো মাস্টার দেওয়া হয়েছে জানো”?... ”স্যার এতগুলো গাইডার (গাইড) পিছনে দিয়েও মেয়েটা জয়েন্টে পেলো না”।
      অর্থাৎ আপনি আপনার ছাত্রছাত্রীদের পিছনে। কেন? পাহাড়ি ট্রেনগুলোর কথা ভাবুন। ইঞ্জিন কোথায় থাকে? পিছনে। আপনার বিদ্যার সুক্ষ্মতা, গভীরতা যাই থাক না কেন, আপনার যদি রীতিমত ট্রেনার হওয়ার যোগ্যতা না থাকে তবে আপনি পারবেন না। কারণ শিক্ষাটা সমতলে নেই আর। সে পাহাড়ের চূড়োয়। কারণ জ্ঞানের আলো নেই আর। জ্ঞান এখন মই, অর্থ-ক্ষমতার চূড়োয় ওঠার মাধ্যম। আলোতে ধাঁধাঁ লাগে যে! তাই পাহাড়ের ঘোরানো পথ, পাশে খাদ, কুয়াশার ঘনঘটা, আপনার সামনে সার দেওয়া ছাত্রছাত্রীদের সার, তাকে ঘিরে ঘিরে তাদের বাবামায়েরা, পিছনে আপনি, গাইডার। আপনি গুঁতোন, আপনি ঠেলুন। আলো সামনে মেলে ধরলে চলবে না, কারণ আলো বোধবুদ্ধি তৈরি করে, প্রতিযোগিতার গতিবেগ তো বাড়ায় না বরং ইতিহাস সাক্ষী, কমায়। আপনার মধ্যে একটা আদিম বর্বরতা না থাকলে আপনি এই ইনস্টিংক্টটা ধরতে পারবে না। লুজার হবেন। তাই আপনি জেনেটিক্স পড়াতে গিয়ে যতই জ্ঞানের মদে বিভোর হন না, আপ্লুত হন না, মানুষের অসামান্য আবিষ্কারে অভিভূত হন না, আপনার দিকে প্রশ্নের বান আসছে, “স্যার কত নম্বর আসছে এর থেকে”? অভিভাবক এসে আবদার করবেন, “স্যর এর থেকে কয়েকটা ইম্পর্ট্যান্ট প্রশ্ন লিখিয়ে দিন না, আমি বাড়িতে ঠিক মুখস্থ করিয়ে নেব।“ আপনি বিস্মিত হয়ে ওয়াটসন ক্রিক, ল্যাক ওপেরণ থিওরি, কোয়ন্টাম মতবাদের উপর থেবড়ে বসবেন। ভাববেন, আমি কে? আপনি কেউ নন, জামাকাপড়ের দোকানের কর্মচারী। যে যে ছিট চায়, যে মাপের চায় তাকে সেই মাপের ফিট করিয়ে পরিয়ে দিন। ব্যস আপনার কাজ শেষ। জামাকাপড়ের হিসাব বোঝাবেন না, সুতোর রসায়ন থাক আপনার মগজে ঘুমন্ত। আমাদের সেই মহাপুরুষ বলেছিলেন না, তোমার যত মদে মাতাল হলে হয় তাই খাও, শুঁড়ির দোকানে কত মদ জেনে কি হবে? ব্যস। এই সার কথা। যা প্রশ্ন আসছে বিগত দশ বছর পরীক্ষায়, যা জেনে অর্থপ্রতিপত্তি লাভ সেই হল জ্ঞান-বিদ্যা, বাকি তো পাগলের প্রলাপ। সে শ্রদ্ধা করার বস্তু, ওকি ঘরে তোলার জিনিস! আবর্জনা হবে না!
      এই হল এক। তার উপরে এসেছে স্মার্টফোন। মধ্যবিত্ত পরিবার, নিম্নবিত্ত পরিবার সে যেই হোক, সংখ্যা গরিষ্ঠতায় ছাত্রছাত্রীদের হাতে স্মার্টফোন আছে। জিও কানেকশান তো আছেই। ঢালা নেট। গেম থেকে পর্ণ, সোশ্যাল নেটওয়ার্ক থেকে টিকটকের মত অত্যন্ত সৃষ্টিশীল মাধ্যম, সব তাদের অবিকশিত, অপরিণত মস্তিষ্কের হাতের মুঠোয়। এইবার আপনি আপনার বিদ্যা ট্রান্সফার করবেন কোথায়? হার্ডডিস্কে জায়গা কই? মনযোগ কই? স্মার্টফোনের মুহূর্ত-লব্ধতার সুখ আপনার বইয়ের পাতায় কোথায়? আপনি কাটছাঁট করুন। আপনি সংক্ষিপ্ত হোন। আপনি শুধু কাজের হোন, বাকিটা চুপ থাকুন। “কি করব স্যার এত বায়না করে”...। মা বাবা সারাদিন স্মার্টফোনে চোখ রেখে বলে যাচ্ছে ওরে “পড় পড়”... বলতে বলতেই খ্যালখ্যাল করে হেসে উঠছেন, কারণ একটা জোক্স এসে গেছে হোয়াটস অ্যাপে। কিম্বা কোনো একদিন প্রচণ্ড রেগে গিয়ে ছেলে মেয়েকে যা তা বলে দিলেন। কারণ দুটো, এক হয় তাদের নিজেদের সোশ্যাল নেটওয়ার্কে অশান্তি, বা তাদের রেজাল্ট প্রচণ্ড খারাপ। এর ফল, ছেলেমেয়ে বাবা-মা কে কাঁচকলা বলে গ্রাহ্য করছে, বাড়াবাড়ি করলে আত্মহত্যা, বা নানা অস্বাস্থ্যকর সংসর্গে স্বর্গবাসের সুখ। আরেকটা কথা, সে সব ছাত্রছাত্রীরা যে সব ফোন ব্যবহার করছে তাদের মূল্যগুলোর দিকে চোখ পড়লে আপনার হাঁমুখে আস্ত ডাইনোসর ঢুকে যাবে একটা। কারণ তাদের অত্যন্ত উন্নত মানের গেম খেলতে অত্যন্ত উন্নতমানের ফোন লাগে, সেই স্বাভাবিক।

      একটা মারাত্মক অবক্ষয় সত্যিই চোখের সামনে দেখছি। পাঠের উৎসাহ, কৌতুহল কি সাংঘাতিক রকম কমছে দিনে দিনে। সব কিছুকে একটা সংকীর্ণ মাপের মধ্যে এনে কাজের বস্তু করে তোলায় যে কি পরিমাণ উৎকর্ষতার ঘাটতি হচ্ছে তা বলার নয়। আপামর ভারতের শিক্ষার আঙিনায় বঙ্গের অবস্থান খুব সুখের নয় সে একটু চোখকান খোলা রাখলেই বোঝা যাচ্ছে। কম্প্রোমাইজ করতে করতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানোর কথা আজও শুনছি না।
      আমার এখন একটা প্রস্তাব খুব মনে আসছে। আমাদের এই কাতারে কাতারে গ্র্যাজুয়েট হওয়ার প্রহসনটা বন্ধ করে হাতেকলমে শিক্ষার প্রসারে আরো মন দেওয়া হোক। আমি দেখেছি, যে বিষয়ে গ্র্যাজুয়েশান করছে তাদের অধিকাংশেরই সে বিষয়ে কোনো আগ্রহ নেই, শুধুমাত্র কলেজে তাদের প্রাপ্ত নম্বরের মধ্যে এসে গেছে আর অনার্স একটা রাখতেই হবে বলে করে নিচ্ছে। একি মানবিক শক্তির অপচয় নয়? তার চাইতে সে যদি হাতের কাজ শেখে কি আপত্তি? অন্তত স্বনির্ভর তো হতে পারবে? নাই বা হল সবাই সরস্বতীর বরপুত্রপুত্রী, বিশ্বকর্মার মান এত নীচে রাখার কি দরকার আছে? বিশ্বকর্মা শিক্ষাই প্রধান আসন গ্রহণ করুক। যে উচ্চশিক্ষা পেতে চায় সেই যাক সেই পথে। এতে মনে হয় একটা ভারসাম্য আসবে। নইলে বন্ধ্যা সার্টিফিকেটগুলোর হাহুতাশে চারদিকে যে অন্ধকার।
      সব শেষে একটা কথা বলে শেষ করি। উপরের চিত্রের ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়। কিন্তু সে শুধুই ব্যতিক্রম। আমাজনের জঙ্গলে যে আগুন লেগেছে তাতে সব প্রাণি পুড়ে মরবে না, এ সত্যি। কিছু বেঁচেই যাবে। যারা পুড়ে মরবে তাদের হয়ত একটা পরিসংখ্যানও বেরোবে। কিন্তু আমাদের এই শিক্ষাব্যবস্থায়, সামাজিক অবক্ষয়ের মধ্যে যে কি পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে তার পরিসংখ্যান কে নেবে? যারা সব কিছুর মধ্যেও নিজেকে বাঁচিয়ে চলে তাদের সংখ্যা কতটুকু? আর বাদবাকিরা, যারা সেই মেধা নিয়ে জন্মায়নি কিন্তু সামাজিক এই অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে তারা যে আপাত মনোরম পথে একটা অন্ধকার খাদের দিকে যাচ্ছ সে কে বোঝাবে?