চিন্তা করতে করতে, ভাবতে ভাবতে ক্লান্তি এসে গেল। কিন্তু সুরাহা কিছুই পাওয়া গেল না। চিন্তা ক্লান্ত করে দেয়, বিশেষ করে যদি কোনো ফলাফলে এসে না দাঁড়ায়।
চিন্তা করা মানুষের স্বভাব। মানুষ মাত্রেই চিন্তাশীল প্রাণী। চিন্তা করে কী হবে - এ অর্থহীন প্রশ্ন। চিন্তা না করে তুমি থাকতে পারো নাকি!
আমি চিন্তা করছিলাম সত্য কী? চিন্তার মধ্যে চিন্তা জাগল, তার আগে বলো, চিন্তা কী?
আমি। আমি নিজেই তো চিন্তা। যে আমি বলছে আমি আজ থেকে কিছুই চিন্তা করব না, সেও তো এক জাতের চিন্তা। চিন্তা নেই, তো আমি নেই। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন আছে। চিন্তা নেই। তাই আমিও নেই। ঘুম থেকে উঠেই চিন্তা শুরু, আমিও শুরু।
আমি চিন্তা। তবে চিন্তা কী, আর আমি কে? এ দুটোই কী একই প্রশ্ন? যদি চিন্তার নাগাল পাই, তবে কি আমার নিজের নাগালও পাব?
চিন্তা মানে কি, কথা বলা মনে মনে? নাকি কোনো কিছুকে নিজের বোধে সচেতনভাবে আনয়ন করা? চিন্তা একটা আয়না। যার মধ্যে ফেলে সব কিছুকে দেখি। চিন্তা কি ভাষাজাত? না। ভাষা চিন্তাজাত। চিন্তা আদিম, অকৃত্রিম বেগ একটা। চিন্তা একটা বেগ। প্রবৃত্তি। চিন্তার মূল আমি কোনোদিন পাব না। কারণ আমি নিজেই চিন্তা।
প্রথম চিন্তা কী? আমি। অহম। জগতে সব চিন্তাই “আমি আছি” এই চিন্তার উপর আধারিত। তবে এই “আমি” চিন্তার উৎস কী?
ঠিক এইখানে দার্শনিক আর মরমীর রাস্তা ভাগ হয়ে গেল। দার্শনিক বলে, “আমি” চিন্তার কোনো উৎস নেই। আমা হতেই জগত শুরু। আমি আছি বলেই সব আমার চেতনায় প্রতিভাত। আমি চোখ বন্ধ করলে সব ফুতুড়।
মরমী বলে, না গো…..”আমি কান পেতে রই…কোন গোপনবাসীর কান্নাহাসির গোপনকথা শুনিবারে…..কে সে মোর… কেই বা জানে…..কিছু তার দেখি আভা…কিছু পাই অনুমানে….কিছু তার বুঝি না বা”......
মরমীর আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখে জল। নদীর ঢেউ শুনে আকুল। সমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে বিহ্বল। তার আমি-কে অশান্ত করে মারছে কে? কী আনন্দে সে পাগল হল?
মরমী বলে, চিন্তা করে পাওয়া যায় না। চিন্তা মানে আমি। আমি মানে চিন্তা। আমি মরলে সে জাগে। কিন্তু তুমি বুঝবে না। তুমি চিন্তা দিয়ে অচিন্তকে ধরবে কী করে? সে ধরা দিলে ধরা যায়। তখন চিন্তা স্বচ্ছ হয়। আমি স্বচ্ছ হয়। সে আমিতে নীলমাধবের ছায়া পড়ে। সে নীল। সে অনন্ত। সে অসীম। সে নিষ্ঠুর। সে প্রেমিক। সে উদাসীন। সে স্রষ্টা। সে রসিক। সে-ই সব। তুমি আমি ঢেউ। সে সাগর।
তাকে পাই কী করে?
সাগরকে যেভাবে ঢেউ পায়। কোনোকালেই হারায়নি জেনে। ওই হারাই হারাই ভয়ই মায়া। চিন্তার খেলা। আমি-র খেলা।
দার্শনিক বলে, বুঝলাম না। আবার যেন বুঝলাম। এ কোথায় এনে দাঁড় করালে? একটা কিছু স্থির করে বলো!
মরমী বলে, স্থির? তুমি নিজে স্থির? স্থির না হলে স্থিরকে জানা যায় না।
দার্শনিক বলে, চিন্তা তো সদা চঞ্চল। আমিও তাই। স্থির তবে কী?
মরমী বলে, যে অচঞ্চল। যে অক্ষুব্ধ। যে নির্ভীক। যে নির্বৈর।
দার্শনিক বলে, সে কে? দোহাই তোমায়, আর হেঁয়ালি কোরো না….স্পষ্ট করে বলো…
মরমী বলে শূন্যগর্ভ শঙ্খের মত হৃদয় হবে যেদিন….কান পাতবে….শুনবে সমুদ্রের গর্জন….চোখ উপচে জল আসবে….জানবে কোথাও কিছু হারাওনি কোনোদিন…..
দার্শনিক বলে, আজ তবে কী করব বলে যাও….
মরমী বলে, আজ তাঁর রথের রশি ধরো….অহং বিসর্জন দিয়ে….মিশে যাও শতসহস্র প্রাণের আকুতিতে…..ধুলো নাও মাথায়……মঙ্গলঘট ভরো করুণার বারিতে…..পঞ্চপল্লবে জাগুক প্রাণ…..করুণায়…..”একি করুণা…করুণাময়”.......শান্তি…শান্তি….শান্তি….