সরস্বতী বড় ভালো মেয়ে। বাবা কাজ থেকে ফিরে এলে বাবাকে জল এগিয়ে দেয়। মাকে রান্নায় সাহায্য করে। কুটনো কুটে দেয়। জল তুলে দেয়। বাসন মেজে দেয়। সরস্বতী স্কুলে গিয়েছিল ক্লাস এইট অবধি। তারপর স্কুলে যায়নি। বাবা "টানতে পারবে না আর", মা জানিয়ে দিয়েছে। দাদারা স্কুলে যায়। বাবা টেনে দেয়।
সরস্বতী বড় ভালো মেয়ে। লক্ষ্মী হয়ে ভাইফোঁটা দেয়। লক্ষ্মী হয়ে দাদাদের বইয়ে, খাতায় মলাট দিয়ে দেয়। লক্ষ্মী হয়ে মাছের যে অংশটাই পাক, বা না পাক সোনা মুখ করে খেয়ে নেয়। মা বলেন সরস্বতী আমার দুর্গা, এক হাতে কতদিক সামলে দেয়।
সরস্বতী বড় ভালো মেয়ে। এক কথায় বিয়েতে রাজী হয়ে যায়। ছেলেও বাবার মত রাজমিস্ত্রীর কাজ করে। ছেলেদের নিজেদের বাড়ি। সরস্বতী লক্ষ্মী হতে সে বাড়ি যায়। সরস্বতী বড় ভালো মেয়ে। দুটো মেয়ে হয়। কেউ বলে, অভাগী, কেউ বলে এর চাইতে বাঁজা হলে ভালো হত, কেউ বলে কি সুন্দর দুটো ফুটফুটে মেয়ে। সরস্বতী আজন্ম বড় ভালো মেয়ে। কাউকে কিছু বলে না।
সরস্বতী চায় মেয়ে দুটো পড়ুক। মেয়ে দুটো স্কুলে গেল। দেখতে দেখতে বড় হল। পড়ার খরচ বাড়ল। স্বামী বলল, আর যে পারি না!
সরস্বতী মাথায় গোল করে রাখা গামছার উপর একটা ইট রাখে, তার উপরে আড়াআড়ি ছ'টা ইট সাজায়, পর পর। বাঁধা বাঁশ বেয়ে ওঠ সরস্বতী। পা টলমল করে। কিন্তু টলমল করলে তো চলবে না। ইটের পরে বসে অমৃতা আর সেঁজুতি। তার দুই মেয়ে। ইট পড়লে তারাও পড়বে। আর পারবে উঠে দাঁড়াতে কোনোদিন?
আজ সরস্বতী পুজো। এক স্কুলের হেডদিদিমণির বাড়ি হচ্ছে এটা। বড় মেয়েটা গেছে কলেজে। ছোটোমেয়েটা গেছে স্কুলে। সরস্বতীকে হেডদিদিমণি প্রসাদ দিয়েছে নিজের হাতে। স্কুলের পুজোর। চোখে জল এসেছে সরস্বতীর। হাতটা ধুয়ে হেডদিদিমণির পা ছুঁয়ে প্রণাম করেছে, আশীর্বাদ চেয়েছে, মেয়েগুলো যেন মানুষ হয় দিদি। বাইকের স্ট্যাণ্ড ওঠাতে ওঠাতে হেডদিদিমণির বর জিজ্ঞাসা করেছে, কি জাত তোরা?
হেডদিদিমণি বলেছে, মায়ের জাত!
হেডদিদিমণি নিঃসন্তান। বাইকে উঠে শাড়িটা ঠিক করতে করতে বলে গেল, আনিস ওদের একদিন বাড়িটা হলে।
সরস্বতী সাতটা ইট মাথায় নিয়ে ভাবতে ভাবতে চলতে থাকে। তার মেয়েদেরও কি কেউ জিজ্ঞাসা করবে, কি জাত তোরা? লজ্জা পাবে ওরা? সংশয় হয়। তবু টলমলে পা'কে শাসনে রাখে সরস্বতী। সরস্বতী চায় না তার মেয়েকে কেউ লক্ষ্মী বলুক, দুর্গা বলুক। সরস্বতী চায় তার মেয়েদের লোকে বলুক, সরস্বতী। বিদ্যেবতী সরস্বতী।
সরস্বতী সন্ধ্যেবেলা ঘরে ফেরে। স্নান করে ঠাকুরের সামনে প্রদীপ জ্বালে। তার ঠাকুরের আসনে বসে হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ। মতুয়া সে। নমঃশূদ্র। নীচ জাত। উচ্চবর্ণেরা বলে। সরস্বতী দুলে দুলে পড়ে,
“খাও বা না খাও, তাতে কোনো দুঃখ নাই।
ছেলেপুলে শিক্ষা দাও, এই আমি চাই।।
ছেলেমেয়েকে দিতে শিক্ষা।
প্রয়োজনে করিবে ভিক্ষা।।
বিদ্যা ছাড়া কথা নাই, বিদ্যা কর সার।
বিদ্যা কর্ম, বিদ্যা ধর্ম, অন্য সব ছার।।
সমাজে পুরুষ পাবে যেই অধিকার।
নারীও পাইবে তাহা করিলে বিচার।।”
পাশের ঘরে শুয়ে শুয়ে সরস্বতীর বর শোনে। তিনটে মেয়েছেলের জেদ দেখে অবাক হয়। আগে তর্ক করত। গায়ে হাত দিত। এখন ছেড়ে দিয়েছে। একদিন ওদের রাস্তায় বার করে দেবে। রোজ ভাবে। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে। পূর্বপুরষেরা লজ্জায় মাথা হেঁট করে হাঁটে। এতগুলো মেয়েছেলে বাইরে বাইরে ঘোরে। বয়স্থা মেয়ে বিয়ের পিঁড়িতে না বসে কলেজের বেঞ্চে গিয়ে বসে। এত অনাচার! নীচু জাতের এত শিক্ষা কেন? তাও মেয়েমানুষ। সব পূর্বপুরুষেরা গুনগুন করে। কিন্তু কেউ জোরে কথা বলে না। সরস্বতীর স্বামীর সকালে ঘুম ভাঙে। উঠানে চেয়ারটায় বসে বসে মা মেয়েদের রঙ্গ দেখে। মাথা গরম হয়। শরীর সাথ দেয় না। তবু প্রতিজ্ঞা করে একদিন বার করে দেবে। ভীতু মন বলে, খাবি কি রে সনাতন ওদের বার করে দিলে? উত্তর দিতে পারে না সনাতন। ঘুমিয়ে পড়তে চায় সে। কেন যে ঘুম ভাঙে, নিজের উপর রাগ হয় সনাতনের।
সরস্বতী সবার আগে বেরোয়। কাজে যায়। সাইকেলের ক্যারিয়ারে মোটা জামাটা আটকানো, যেটা কাজের সময় শাড়ির উপর পরে, আর লাল গামছাটা, যার উপর মাথায় প্রথম ইটটা রাখে। সামনে হ্যাণ্ডেলে ঝোলানো নাইলনের ব্যাগে একটা টিফিনবাক্স। ভাত আর একটা তরকারি থাকে সাধারণত। আজ অল্প একটু পায়েস আছে। বড় মেয়েটার জন্মদিন।
আজ সরস্বতীপুজো। মুখটা আর মনটা মিষ্টি হয়ে আছে স্বপ্নে। সেও মানুষ। তার মেয়েরাও মানুষ। মানুষের মত মানুষ। গর্বে বুকটা ফুলে ওঠে সরস্বতীর। ইটের ভার হাল্কা হয়ে যায়।
“শুন কন্যা, গুণে ধন্যা, আমার বচন।
জাতি-ভাগ মোর ঠাঁই না পাবে কখন।।”
হেডদিদিমণির বরের মুখটা মনে পড়ে, কি জাত তোরা!
সে মনে মনে বলে, সরস্বতীর জাত গো!