“রান্নাঘরে ঢোক। ঢুকে ডালের কৌটোর পিছনে দেখ শুকনো লঙ্কার কৌটো রাখা। ওই কৌটোটা পাড়। দেখিস পড়িস না যেন। ওর মধ্যে হাত ঢোকা। চারটে পাঁচশো টাকার নোট পাবি, নিয়ে আয়।”
লক্ষ্মী ফোনটা কেটে, ফোনে লাগা ঘামটা আঁচলে মুছে আবার চেয়ারে গিয়ে বসল। আজকেই সব টেস্ট করতে হবে কে জানত? ছেলেটা অপ্রস্তুত হয়ে যখন সামনে এসে দাঁড়ালো, কি মায়া লাগল। যেন ছোটোবেলার সন্তু। আবার ঘুড়ি কেটে গেছে।
বৌমা টাকাটা নিয়ে আসবে। ডাক্তার আজকেই সব টেস্ট করিয়ে নিতে বলছে, তবে অপারেশনের ডেট তাড়াতাড়ি পাওয়া যাবে। বাঁদিকের চোখটাতে তো কিচ্ছুই দেখা যাচ্ছে না। ছানি পেকে গেছে নাকি।
লক্ষ্মী বসে বসে পা দুলাচ্ছে। এই টাকাটা রেখেছিল টালিগুলো সারাতে দেবে বলে। শীতে বৃষ্টি হলে বড় কষ্ট হয়। তার উপর নাতিটার বারোমাস কাশি-সর্দি।
লক্ষ্মী সন্তুর দিকে তাকালো। ছেলেটা মুখটা কালো করে বসে আছে। গত মাসে নিজের থেকেই এসে বলেছিল, মা টাকা জোগাড় হয়ে গেছে, চলো। লক্ষ্মী তখন সদ্য বাড়ি এসেছে রাতে। লক্ষ্মী বিড়ি বাঁধার কাজ করে। সময় পেলে ঠোঙাও বানায়। সন্তু যখন যেমন কাজ পায় তেমন করে। বউমা চার বাড়ি বাসন মাজে।
শুকনো লঙ্কা বাড়িতে কেউ খায় না। পেট জ্বলে বাবুর। তবে মাঝে মাঝে লাগে। ওই টাকাটা তাই ওই কৌটোর মধ্যেই লুকিয়ে রেখেছিল লক্ষ্মী। নিজের কাছ থেকেই। নিতে গেলে যাতে হাত জ্বালা করে।
দরজায় দাঁড়ানো লোকটা তাকাচ্ছে তার দিকে বারবার। লক্ষ্মী চোখ সরিয়ে নিচ্ছে। ওদিকে গিয়েই কথাগুলো ফোনে বলছিল লক্ষ্মী। শুনেছে নিশ্চয়ই। কিন্তু কতবার দৃষ্টি চুরি করা যায়? তাকালো লক্ষ্মী সোজাসুজি।
লোকটা ইশারায় ডাকল।
একটা নীল শার্ট আর হলুদ প্যান্ট পরে টুলে বসে। জামা খুলে দিলে হয় তো সব কটা পাঁজর গোনা যাবে।
লক্ষ্মী গিয়ে সামনে দাঁড়ালো। কি বলতে চায়? ফেলে এসেছে কিছু?
লোকটা লক্ষ্মী আসছে দেখেই উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। লক্ষ্মী আসতেই বলল, বৌদি আপনি আমাকে চিনবেন না। দাদা আর আমি একই মিলে কাজ করতাম। দাদা চলে যাওয়ার পর মিল বন্ধ হল। আমি এইখানে। আমার অনেকক্ষণ ধরে আপনাকে চেনা চেনা লাগছিল। তারপর যেই কথা বললেন, আপনার ভাষায় এখনও ওপার বাংলার টান…..
লক্ষ্মীর মাথার মধ্যে অনেকগুলো ছবি এসে গেছে একসঙ্গে। দানা বাঁধছে না কেউ কারোর সঙ্গে। মিলের জামা, সকালে চায়ে চুমুক দিতে দিতে গল্প করা পরিতোষ, মানে সন্তুর বাবা, আগের ভাড়া বাড়ির দালান, সন্তুর স্কুলের ব্যাগ, পরিতোষের চন্দনের টিপ দেওয়া মৃত মুখ, রাস্তায় শোয়ানো, বাড়ির দরজার সামনে… এ কে?
আমি ভবা বৌদি… ভবা দাস। আপনার মনে নেই। বাবুর বিয়েতেও গেছি আমি।
লক্ষ্মী হাসল। সন্তুকে দেখল একবার। সিটে বসেই তার দিকে তাকিয়ে আছে। দূর থেকে।
বলছি দিদি, হেলথ কার্ড নেই?
লক্ষ্মী বলল, না।
ভবা বলল, আমি কথা বলব? যদি দু চারশো টাকা কমে…. আপনি আসবেন আমার সঙ্গে?
দরজায় মনা এসে দাঁড়ালো। সারা মুখ ঘামে ভেজা। কালো চুড়িদারটাই পরে এসেছে। চার বছর আগে পুজোয় লক্ষ্মী কিনে দিয়েছিল।
লক্ষ্মী বলল, বউমা আমার।…. বউমা… ইনি সন্তুর বাবার বন্ধু ছিলেন….
ভাই… ভাই… ভাইয়ের মত ছিলাম বৌদি…..
ভবা হাসল। হাসিটা বড় করুণ। নিজের বলে কেউ না থাকলে এমন হাসে মানুষ। কাউকে খোঁজে। হাসি দিয়ে। বোকার মত হাসি।
লক্ষ্মী মনার হাত ধরে বলল, চল বসি।
লক্ষ্মী মনার হাত থেকে টাকাটা নিল। শুকনো লঙ্কার গন্ধ। নাকটা টাটিয়ে উঠল। চোখটাও। নাতিটার মুখটা, ফাটা টালি দিয়ে আসা মেঝেতে পড়া রোদের লাঠি, সন্তুর বাবার মুখটা সবটা মনে পড়ল। এমন কিছু কান্না থাকে যা কাঁদা যায় না। বুকের চৌকাঠ ভিজিয়ে যায়। চোখ অবধি আসে না।
মনা সন্তুর পাশে দাঁড়িয়ে। তারা কেউ তাকাচ্ছে না এদিকে। ভবাও অন্য দিকে তাকিয়ে। লক্ষ্মী কাউকে বলবে না দু চারশো টাকা কমানোর জন্য। কাউকেই না। সন্তুর বাবার জন্য এটুকু করতে পারবে না?