মেসেজটা ঢুকল। 'কলকাতায়'। ব্যস। আর কিছু লেখা নেই। মল্লিকা টয়েলেটে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ। চারদিক নিস্তব্ধ। আগরপাড়া স্টেশান কাছেই। ট্রেনের আওয়াজ এলো।
ভোরের ট্রেন। সব্জী যায় এই সময়ে। মল্লিকা জানে সে পুরো নারী হয়ে উঠতে পারেনি। অত টাকা কোথায়? কিন্তু না হোক নারী সবার চোখে। অতনু জানে সে নারী। বাকি সবার কাছে সে দুর্বল, অসম্পূর্ণ পুরুষ একজন। অশক্ত। দর্জির দোকানে কাজ করা। অতনু তার সঙ্গে কলেজে পড়ত। ওর কেমিস্ট্রি অনার্স। তার ইতিহাস। কলেজ শেষ হল কই? দোকানে কাজ নিতে হল। কলেজে কি পেলি মল্লিকা? একরাশ অপমান, লজ্জা আর কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ার মত একটা জিনিস - অতনুর চুমু।
সেদিন ভীষণ বৃষ্টি। কলেজ প্রায় ফাঁকা। অতনু আর মল্লিকা গিয়েছিল তবু। ভুল বলছি। সেদিন সে মল্লিকা না তো, সেদিন সে দিব্যেন্দু। নামটা একটা বোঝা। শরীরটা বাধা। মনের অনুভব, মনের তৃষ্ণা শরীর অনুবাদ করতে পারে না। কেন এমন হল? কি যেন একটা ঠিক নয় দিব্যেন্দু ছোটোবেলাতেই বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু ঠিক কি যে নয় আজও বোঝেনি। বা বুঝলেও মেনে নিতে পারেনি।
দিব্যেন্দুর শরীরের ছলনা এড়িয়ে চোখের ভাষা বুঝেছিল অতনু। যেদিন প্রথম তাকিয়েছিল, সারা শরীরে অসাড় হয়ে গিয়েছিল। হাতের তলা, পায়ের তলা হিম ঠাণ্ডা। চোখ ফিরিয়ে নিতে চেয়েছিল। ফিরিয়ে নিয়েওছিল, শুধু আরেকবার তাকাবে বলে। তাকিয়ে ছিলও। হ্যাংলার মত। অতনু হেসেছিল। মৃদু। দিব্যেন্দু হাসার চেষ্টা করেছিল। পারেনি।
ক'দিন অতনু এড়িয়ে গিয়েছিল। ভেবেছিল নাকি দিব্যেন্দু অফেণ্ডেড হয়েছে, পরে শুনেছিল অতনুর মুখেই। ভুল কিভাবে ভেঙেছিল অতনুর মনে নেই। তবে ফাজলামি করে বলে 'নীল রঙ' এর জন্য। ঘটনাটার পরে পরেই কদিন ধরে অতনু জ্বরে পড়ল। ধুম জ্বর। হোয়াটসঅ্যাপে একদিন মেসেজ করল, কেমন আছিস?
দিব্যেন্দু অবাকই হয়েছিল। নাম্বারটা সেভ ছিল না। সেভ করার পর ডিপি দেখে চিনতে পারল। দুর্গাপুজোর সপ্তমী ছিল। দিব্যেন্দু পুড়েছিল সেদিন। কিন্তু পোড়াদাগ লুকিয়েই বাঁচতে চেয়েছিল। অতনু দিল কই? মানুষ ক'বার একই জায়গায় পুড়তে পারে? দশমীর দিন আচমকা শুনল ওকে নার্সিংহোমে ভর্তি করতে হয়েছে, ডেঙ্গু হয়েছে। প্লেটলেট কমে যাচ্ছে। অতনুর ফোনটা তখন ওর মায়ের কাছে। আন্টিই দিল বলে দিল কি করে আসতে হবে বাগুইহাটির নার্সিংহোমে। মনে আছে নামটা - স্বস্তি।
দিব্যেন্দু গিয়েছিল। দুদিন পর পর। তারপর যায়নি আর লজ্জায়। নিজের চোখকে ভয় পেত। অতনুকে বেডে শোয়া দেখে কান্না পেত। নিজেকে বলত, এত… এত কেন?!
পোড়া দাগে তখন মাটি জমেছে। বীজ পড়েছে ভাষায় ভেসে আসা ভালোবাসার। হয় তো অঙ্কুর ধরেওছে। দেখতে চায় না দিব্যেন্দু। ভীষণ কষ্ট হবে পরে। এ বিষ নিয়ে খেলা। শুধুই সে-ই তো পুড়বে। অতনু তার মত নয়। তবে কেন?
তিনদিনের দিন গেল আবার। না চাইতেও গেল। নিজেকে বলল, বেহায়া। সেদিনই মরল। কে জানত তার নীল পাঞ্জাবিই তার মরণের পরোয়ানা নিয়ে আসবে!
অতনু ভালো আছে। ছেড়ে দেবে কাল। কেবিনে কেউ নেই। অতনুর পাশে রাখা চেয়ারে বসল দিব্যেন্দু। অতনুর ক্লান্ত চোখ। তার দিকে অপলক তাকিয়ে। এ দৃষ্টি ভালো না… অতনু অন্যদিকে তাকাও… প্লিজ.. বুঝছিস না কেন… আমি কেঁদে ফেলব… হাত.. কেন হাত কেন?
দিব্যেন্দুর হাতটা ধরেছে অতনু। দিব্যেন্দু ছাড়িয়ে নিল। অসহ্য। আমায় বাঁচতে হবে অতনু। বাবা অসুস্থ। ক্যান্সার গলায়। অনেক দেরি হয়ে গেছে। মা আর পারছেন না। আমিও আর কদিন কলেজে জানি না।
এত কথা নিজেকেই বলল দিব্যেন্দু। বাইরে তাকালো শুধু। সন্ধ্যে হয়ে আসা কলকাতার দিকে।
আন্টি আসছে। মেসেজ করল। নীচে আছে। কি সব পেমেন্টের জন্যে। দিব্যেন্দু একটু সহজ হয়েছে। অতনু তার দিকে তাকিয়ে। নার্স এসে ঘুরে গেল দুবার। অতনু কি স্বাভাবিক ব্যবহার করল। দিব্যেন্দু পারল না। মনে হল সবাই সব বুঝে যাচ্ছে। বীজটা চিরে বেরোচ্ছে অঙ্কুর। অতনু যন্ত্রণা হচ্ছে তো… বোঝো তুমি… বুঝিস তুই?
বোঝে না। পরের দিন বেলায় মেসেজ এলো, 'বাড়ি ফিরেছি।' সঙ্গে দুটো চুমুর ইমোজি। দিব্যেন্দু মরল।
=========
বৃষ্টি পড়ছে। ক্লাস হবে না। মেসেজ এলো ফিজিক্সের ঘরে আয়।
দিব্যেন্দু গেল। অভিসার? তা না তো কি? নইলে পুরো কলেজ ক্যাম্পাস এক মুহূর্তে ব্লটিংপেপারে শুষে নিল যেন কেউ। সময় দোকানের ঝাঁপ ফেলে যেন গেল বাড়ি। বুকের ভিতর লাইন পাতা। ছুটছে ভাগীরথী এক্সপ্রেস। কি কাঁপুনি। জ্বর আসছে? মনে হচ্ছে। শ্বাস দ্রুত। সারাটা মুখ দিয়ে হল্কা বেরোচ্ছে।
দিব্যেন্দু ঢুকতেই মাথাটা টেনে নিল নিজের দিকে অতনু। কিছু বোঝার আগেই নিজের ঠোঁটদুটো বসিয়ে দিল তার ঠোঁটে। প্রথমে সিগারেটের গন্ধ। তারপর তলিয়ে যাওয়ার শব্দ। মাথাটা শূন্য। পিঠের দিকে হাতটা দিয়ে জড়িয়ে আছে অতনু। দিব্যেন্দু ঠোঁটের আগল খুলে দিল। যাক ভেসে সব।
=======
দিব্যেন্দু কলেজ ছাড়ল। বাবা নেই। দোকান চালাবে কে? অতনু বোঝালো অনেক। শুনল না। তখন অতনুর নতুন মেয়ে বন্ধু। ঝুমা। বোটানি অনার্স। ভালো মেয়ে।
কলেজ ছাড়া নিয়ে অতনু অভিযোগ করেনি। অধিকার কই? কি দেবে সে? যৌনতার উষ্ণতা দিয়ে কি হৃদয় কেনা যায়?
কিন্তু অতনুকে একদিনও অপমানিত করেনি দিব্যেন্দু। বুঝিয়েছিল তার ঝুমা অতনুর বিকল্প না, সে অন্য চাহিদা। দিব্যেন্দুর জায়গা সে নেবে না। নিতে পারে না।
দিব্যেন্দু চলে যায়নি। কোথায় যেত? অতনুর আদরে নেশা জাগেনি। কিন্তু অতনুর ভালোবাসায় কোনো খাদ ছিল না। আদর ছোটোবেলা থেকে অনেক পেয়েছে দিব্যেন্দু। আত্মীয়রাই কি ছেড়েছিল? "কি নরম রে তোর শরীর… তোর গাল… তোর পাছা… তোর উরু.. তোর হাত…"।
অতনু নিংড়ে চায়নি দিব্যেন্দুকে, আবিষ্কার করেছে বারবার। নিজের শরীরকে, নিজের আত্মাকে পরতে পরতে জেনেছে দিব্যেন্দু অতনুর ভালোবাসায়। এত স্নিগ্ধ যে কারোর নগ্নতা হতে পারে অতনুকে না দেখলে বিশ্বাস করত দিব্যেন্দু!
=========
অতনু চাকরি পেল ব্যাঙ্গালোরে। বিয়ে করল, ঝুমাকে নয়। অতসীকে। দেখেশুনে বিয়ে। গেল না দিব্যেন্দু। অতনু রাগ করেনি। বুঝেছিল। যদিও গেলেও অসুবিধা হত না দিব্যেন্দুর, তবু যায়নি। অতসীকে চেনে না যে। ঝুমা হলে যেত। ঝুমা ব্যাঙ্গালোরে যাবে না। বাড়ির লোক বাড়ির কাছে ছেলে চায়। এক মেয়ে। অতনু কষ্ট পেয়েছিল। দীঘা গিয়েছিল দিব্যেন্দুকে নিয়ে। সেই প্রথম তিনদিনে একদিনও টাচ করেনি অতনু দিব্যেন্দুকে। বলেছিল তোর যদি মনে হয় আমি তোকে ইউজ করছি…
দিব্যেন্দু বলেছিল, বেশি ভাবছিস। মনে মনে খুশি হয়েছিল যদিও। এটাই তো তার অতনু। শেষদিনের রাতে সে জোর করেছিল। তাই হয়েছিল। নইলে ফিরে এসে ক্ষমা করতে পারত না দিব্যেন্দু নিজেকে। এত স্বার্থপরও তো সে নয়। সব সম্পর্কেই সবাই কেউ না কেউ, কাউকে না কাউকে ব্যবহার করেই ফেলে। বাধ্য হয়েই করে। ওটুকু মেনে নিতে হয়। অত হিসাব করে ভালোবাসা বাঁচে না। আলোছায়ার রাস্তা তার। আলোটুকু শুধু নেব বললে হয়?
=========
এবারে পুজোয় আসার কথা ছিল না অতনুর। তবু এসেছে। তার জন্যেই এসেছে। লেকটাউনে বাড়ি। আজ রাতে ফিরে যাবে। শেষ রাতে ফ্লাইট। দাবি জানিয়েছে দিব্যেন্দু যেন ভোরে আসে। ভোর মানে সকাল আটটা হলেও হবে। যেন ভোরের ঘুম ভাঙে দিব্যেন্দুর কলিংবেলের আওয়াজে। এক ছেলের বাবা হয়েও এত রোম্যান্টিকতা আসে কি করে বাপু!
বিধাননগর থেকে অটোতে উঠল দিব্যেন্দু। না, এখন সে মল্লিকা। জিন্স আর নীল পাঞ্জাবি পরেছে। যে পাঞ্জাবি আজ রাতের বেলায় ভিজবে। চোখের জলে। প্লেনটা কালো আকাশে মিশে গেলে।
দিব্যেন্দুর চোখের নীচে আলতো কাজলরেখা। পিঠে ব্যাগ, এখন কোলে রাখা। ব্যাগে অতনুর জন্য একটা লাল টিশার্ট, জিন্স আর অতসীর জন্য একটা লাল শাড়ি, আর বুম্বার জন্য গেঞ্জি। ভালোবাসা ডালপালা মেলে দাঁড়িয়ে আছে দিব্যেন্দুকে নিয়ে এখন। বুম্বার ছবি পাঠায় অতসীও, হোয়াটসঅ্যাপে। ভালোবাসা ডালপালা মেললে পরিপূর্ণ হয়। সব ডালে মিষ্টি ফল ফলে কি? তবু সব নিয়েই তো জীবন। ফাঁকি তো নয়!
কলিংবেল বাজল। একবার। দু’বার। তিনবার। কেউ খুলল না।
মোবাইলটা অন করল। রিং হচ্ছে না। নেট অফ। অন্ করল। হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ এলো---
"আমি রাতেই ফ্লাইটে ফিরে যাচ্ছি, বুম্বা সিঁড়ি থেকে পড়ে গেছে। তুই ঘুমাচ্ছিস বলে আমি আর কল করলাম না। পরে যোগাযোগ করছি।"
=========
আধঘন্টা সিঁড়িতে বসে থাকল দিব্যেন্দু। চোখ ভরে এলো। রুমালে মুছল। আবার ভরে এলো। আবার মুছল। উঠে দাঁড়ালো। দরজার হাতলটা ছুঁলো। অতনুর হাতের গন্ধ।
ট্যক্সিতে উঠল।
কোথায় যাবেন?
দক্ষিণেশ্বর।
ছেলেটার নামে পুজো দিতে হবে। হোয়াটসঅ্যাপ করল,
"আমি মায়ের কাছে পুজো দিচ্ছি। ভাবিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে। ভালো থাকিস।"
দিব্যেন্দুর নীল পাঞ্জাবির বুকে জলের দাগ। শুকিয়ে যাচ্ছে শরতের হাওয়ায়।