সৌরভ ভট্টাচার্য
20 December 2016
ছেঁড়া ছেঁড়া কিছু পুঁথির মালা জড়ো করে এনেছি। তুমি একটা মালা গেঁথে দেবে? সব পুঁথি আনতে পারলাম কই? কিছু নিল পাখিতে, কিছু হারালো ঝড়ে, কিছু পড়ল কোঁচড় থেকে অজান্তে, আর কিছু বেরোলো ফুটোফাটা। তবু যে ক’টা এনেছি তাদের একটা সুতোয় গেঁথে দাও না।
আমার জন্যে বিশেষ কেউ অপেক্ষা করে না। কারোর জন্যেই করে না। অপেক্ষা করে সবাই নিজের প্রয়োজনের। এ সংসারে এক তোমারই প্রয়োজন হল আমাকে। আমার কাছে কিছু প্রয়োজন নেই তোমার। আমাকেই চাও। কেন?
দেখো সংসারে চলতে ধুলোবালি লেগেছে অনেক। যতটা না দরকার ছিল, তার চাইতেও লেগেছে অনেক বেশি, কারণ যতটা না দরকার ছিল ঘেঁটেছি তার চাইতেও বেশি। নেশা লেগেছিল।
কিছুই সহ্য করতে পারি না। কারোর এতটুকু ত্রুটি বিচ্যুতিতে প্রাণে আগুন জ্বলে যায়। অথচ দেখো, নিজের পর্বতপ্রমাণ ত্রুটি ঢেকে রাখার চেষ্টা করছি তোমার আঁচলের আড়ালে। প্রশ্রয় খোঁজার চেষ্টা করছি 'মা' শব্দের আড়ালে। কত চাতুরী, কত মতলব, কত গোপন বাসনাকে বলছি, শ্ শ্... বাইরের লোকে টের পাবে, ধীরে ধীরে হাঁটো মনের অলিতে গলিতে। এমন জামা পরে বাইরে বেরোও যেন লোকে তোমার আসল শরীরটা চিনতে না পারে। ভয় নেই, লোকে পোশাক দেখেই চরিত্র ঠাহর করে।
কিন্তু দেখো, বারবার ধরা পড়ছি তোমার সামনে। মুখ থুবড়িয়ে পড়েই দেখি কেউ নেই চারপাশে, যাদের নাকি থাকার কথা ছিল, হাত ধরে তোলার কথা ছিল। তখন আমার সামনে দুটো রাস্তা খোলা। এক, পড়ে থাকা অবস্থাতেই নিজেকে মানিয়ে নিয়ে বলা - আহা এই তো বেশ আছি। দেখো রাম শ্যাম যদু মধু সব্বাই তো পড়ে গিয়েও টিকে আছে। তুমি থাকবে না কেন? এই গেল প্রথম পথ। আর দ্বিতীয় পথ হল, কে ডাকছে শোনো। বাইরে না। ভিতরে। কার একটা অর্ধেক পড়া, অর্ধেক ভোলা চিঠির কথা যেন মাথার মধ্যে গরমকালের ভোরের হাওয়ার মত সুখ দিয়ে যাচ্ছে, সাথে একটা ব্যথা। অর্ধেক মনে না পড়ার ব্যথা, অর্ধেক পড়ার ব্যথা।
দ্বিতীয় ডাকেই সাড়া দিলাম। তোমার চোখের কোণের থেকে একটা আলো বলল, উঠে দাঁড়াও। মানুষ সম্পূর্ণ পড়ার মত পড়তে পারে না কখনোই, যতক্ষণ না সে মাটির উপর বিশ্বাস হারায়। কারণ মানুষ দাঁড়ায় মাটিতে, নিজের পায়ের গর্বে সে খানাখন্দে গিয়েও পড়তে পারে, কিন্তু মাটির ভাষা বুঝলে সে বোঝে মাটি শাসনও করে। পা'কে শুধু না, পায়ের বেগকেও।
তোমার দিকে তাকিয়েই তাই বারবার উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা। নিয়মের ভয়ে না, সব নিয়মের বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যে শক্তি বাইরে যেতে চায় না, সেই শক্তির ভাষার অধীন হয়ে। সহ্য করার মধ্যে নিজের শক্তির অনেকখানি পরিচয় পাওয়া যায় বলেই সময়কে বলতে হয় না,"শত্রুতা করছিস?" সময়ের সাথে কাঁধ মেলায় ছয় ঋতু নিশ্চিন্তে, শুধু কালবৈশাখী পারে না বলেই সে ঋতু না, একটা দুর্যোগ। তার শক্তি আছে, কিন্তু সে শক্তির দিশা নেই। দিশা নিয়ম দেয় না, দিশা দেয় সেই শক্তি যা দুর্বলের সীমারেখাকে স্বীকার করে তার মর্যাদা রাখে তার অলক্ষ্যেই, সে এক বিষম শক্তি, যার নাম তুমি বলো ভালোবাসা। যেন সমুদ্র, সারা পৃথিবীকে প্লাবিত করার শক্তি থাকলেও সে নিজের সীমার মধ্যে শান্ত, ভালোবাসার মত কোমল। যেন লক্ষকোটি নক্ষত্রপুঞ্জের মত, সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে এক লহমায় ধূলিসাৎ করতে পারে জেনেও তারা নিজের নিজের কক্ষপথে শান্ত হয়ে আপন মর্যাদায় ঘুর্ণায়মান। মাঝে মাঝে দুর্যোগ আসে না তা তো নয়; তবে তা শুধুই দুর্যোগ, নিয়ম না, ব্যতিক্রম। ভালোবাসার মত, সেই চিরকালের বলেই হিংসা এমন হিংস্র, অথচ অসহায় নিজের আয়ুষ্কালের ঘেরে।
অবশেষে তাই ভালোবাসার নাম বদলে হয় - ক্ষমা, ত্যাগ, সহিষ্ণুতা। আমি এক কথায় বলি – ‘মা’।
[আজ শ্রীশ্রীমা সারদাদেবীর শুভ জন্মতিথি]