Skip to main content
anjana

 

"কিন্তু মা, এত বড় জাহাজের সঙ্গে, একটা ছোটো নৌকা বাঁধলে, বারবার ঢেউ খাব যে! আমি টাল সামলাতে পারব না। তুমি বরং না-ই বলে দাও"।

এতবড় সংসারের দায়িত্ব নিয়ে চলছে যে ছেলে, সে-ই বলল এই কথা। যে বাড়ি থেকে সম্বন্ধ এসেছে তারা অনেক অবস্থাপন্ন, কিন্তু এদিকে সে লড়াইয়ের মধ্যগগন। পায়ের তলায় অল্প খানিক মাটি জোগাড় করা গেছে। বাগান হল কই?

মা ছেলের কথাই জানিয়ে দিলেন মেয়ের বাবাকে। মেয়ের বাবার 'হ্যাঁ' আরো শক্ত 'হ্যাঁ' হল। এ জোর যে মানুষের আছে, সে মানুষের নৌকা জাহাজের সঙ্গে বাঁধা লাগে না। সে নিজের দাঁড় বাওয়ার জোরেই পাড়ি দিতে পারে জীবন সমুদ্র।

=====

ভুল ছিলেন না। ক্রমে পায়ের তলার অল্প খানিক জমি আকারে আয়তনে বাড়ল। যে বেড়ার বাড়ি ছিল, যা অল্প হাওয়ায় ধ্বসে পড়ে যেতে পারত, সে ঝড় সামাল দেওয়ার মত তৈরি হল।

সেকি একার জোরে? না, নতুন যে মানুষটা পরিবারে এসেছেন তিনি যাদু জানেন। মানুষকে আপন করার। তার স্নেহে উচ্ছ্বাস নেই, শাসন আছে। ভালোবাসায় প্রশ্রয় নেই, আগল আছে। গোটা সংসারটাকে দু'হাতে ঘিরে দাঁড়ালেন দশ হাতের শক্তি দিয়ে। ছোটোবেলা থেকে দুর্গাপুজো দেখেছেন নিজের বাড়ির বারান্দায়। জানেন তো দুর্গা কিভাবে ঘরের মেয়ে হয় সমস্ত দেবীত্বকে অতিক্রম করে।

অফিসের পিকনিকে নিজের ছেলেমেয়ের সঙ্গে যাচ্ছে ননদ, দেওর। বাপের বাড়ি যাওয়ার সময় কোথায়? একে একে ননদদের বিয়ে দেওয়া, দেওরদের সংসারী করা, নিজের ছেলেমেয়ে মানুষ করতে করতে অসম্পূর্ণ পড়াশোনাকে সম্পূর্ণ করা --- সব হচ্ছে। সব হলও সময়মতো। কুমোরটুলি থেকে যখন ঠাকুর বেরোয়, সব প্রতিমায় যেমন শিল্পীর হাতের ছোঁয়া থাকে, গোটা সংসারটার প্রতিটা কোণায় তাঁর হাতের ছোঁয়া থাকল, প্রতিটা মানুষের জীবনের গড়ে ওঠার সময়ের কিছুটা সময় তাঁর হাতে বোনা ভালোবাসা, স্নেহ, শাসনের ওম নিয়ে থাকল। সব হল সময়মতো, কিন্তু তিনি যাওয়ার পথে পা বাড়ালেন বড় তাড়াতাড়ি। রক্তে বেঁধেছে মারণরোগ। সমস্ত চিকিৎসক বললেন, অনেক দেরি হল যে। প্রস্তুত হোন। আর মাত্র ছ-মাস সময় হাতে।

=====

যে সম্পর্কগুলো ফ্যামিলি ট্রি-তে জায়গা পায় না, কিন্তু এমন অবিচ্ছেদ্য শাখাপ্রশাখা হয়ে যায় যে তাকে ছাড়া জীবন অসম্পূর্ণ বোধ হয়, যে পরিবারের গল্প বললাম আমার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক তেমনই।

এখন আমি কি করব? যে মানুষটাকে কোনোদিন বিচলিত হতে দেখিনি, কখনও কোনো অভিযোগ করতে শুনিনি, যে মানুষটার চোখের দিকে তাকালে নিজের হারানো আত্মবিশ্বাস নোঙর পায়, সে মানুষটার শেষদিনগুলোর সময় দাঁড়াব কি করে?

তিনিই সহজ করে দিলেন। কথা বলতে বলতে চোখে জল এলো তাঁর, আঁচলে মুছলেন, কিন্তু ভেঙে পড়লেন না এক মুহূর্ত। শেষ শ্বাসটুকু অবধি না। প্রচণ্ড কষ্টের সময় বলেছেন, আমায় একটা ইঞ্জেকশন দিয়ে দাও না, তবে তো তোমাদেরও এত কষ্ট করতে হয় না। এই মাঝে মাঝেই নার্সিং হোমে যাও, রক্ত দিয়ে নিয়ে এসো, আমারও আর ভাল্লাগে না। সব শেষ করে দাও না!

আমি যতক্ষণ বসে থাকতাম, ওঁর হাতটা ধরে বসে থাকতাম। হাস্পাতালে যখন পাশে দাঁড়িয়েছি, দুর্বল হাতটা কম্বলের ভিতর থেকে বার করে আমার ক্ষমতাহীন, দুর্বল হাতটার উপর রেখেছেন। কি আশ্বাসে, কি বিশ্বাসে! নিজের অসহায়তায় ভিতরে ভিতরে মাটিতে মিশেছি। কিন্তু হাতটা ধরে রেখেছি শক্ত করে। গল্পের পর গল্প বলে গেছি। উনি হেসেছেন। সবটা যে অভিনয় করছি, ওঁর মত বুদ্ধিমান মানুষ কি বোঝেননি? কিন্তু আমাদের বিব্রত করেননি একদিনও। ওই যে বললাম, কোনো অভিযোগ ছিল না কোনো মুহূর্তে! এমনকি ঈশ্বরের কাছেও না। যেখানে অনেক বড় বড় নাস্তিক মানুষকেও দেখেছি মাথা কুটতে, তিনি আমাকে কেন, সেই ঈশ্বরকেও বিব্রত করেননি। থাকতে দিয়েছেন তাঁকে তাঁর মত করে।

একবার বললাম, কাকিমা অ্যালবামগুলো দেখব। আপনার ছোটোবেলার ছবি। আপনার ফেলে আসা দিনগুলোর ছবি।

বার করে রাখলেন। পরেরদিন যেতেই এনে দিলেন। আমি সাধারণত শনি আর রবিবারই যেতাম। এক সপ্তাহের অনুরোধ ওই দুর্বল শরীরে পরের সপ্তাহেই রাখলেন। তখন ভীষণ শ্বাসকষ্ট। তাও বুকে ভর দিয়ে উঠে উঠে এক একটা ছবি প্রায় রক্তশূন্য আঙুলগুলো দিয়ে দেখাচ্ছেন। গায়ের কম্বল শীর্ণ হয়ে যাওয়া দেহ থেকে খসে খাটে পড়ে যাচ্ছে, ফুরিয়ে আসা শ্বাসের যতটুকু কুলায় টেনে টেনে আমাদের দেখাচ্ছেন, পরিচয় করাচ্ছেন নিজের বাবা, মা, শ্বশুর, ননদ, দেওর সবার সঙ্গে… অল্প ভাষায় বর্ণনা করছেন কোনো মুহূর্তের। এত আবেগ! সব মুহূর্তের সঙ্গে এত আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে যে মানুষটা, তুচ্ছ থেকে তুচ্ছতম ঘটনা যার স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে, সে মানুষটা নাকি সবটুকু ছেড়ে যাবে! যেতেই হবে!?

=====

উনি থাকতেন দোতলায়। আমি নীচের তলায় নিজেকে প্রস্তুত করে উপরে উঠতাম, এক গভীর প্রসন্নতাকে প্রার্থনা করে। কারণ যে মানুষটার পাশে গিয়ে বসব, সে মানুষটা জীবনের চোখের উপর চোখ রেখে বেঁচেছেন। লুকিয়ে নয়।

আর যে মানুষটার হাত ধরে সংসারে ঢুকেছিলেন? শেষক্ষণ অবধি সে মানুষটা হাত ছাড়লেন না। এমনকি যে ভোরে শরীর থেকে শেষ শ্বাসটুকু বেরিয়ে গেল যে ক্ষণে, সে ক্ষণের কয়েক মুহূর্ত আগেও নাকের কাছে হাত রেখে দেখেছেন শ্বাস চলছে কিনা।

যে মানুষটা চাকরি থেকে অবসর নিয়ে, সব দায়িত্বকে সম্পূর্ণ করে একটা অখণ্ড শান্তির আশা করেছিলেন, সে মানুষটাও হেরে গেলেন না। ভাগ্যের চোখে চোখ রেখে বললেন, বেশ…. তবে তাই হোক।

সেবার বাইরেটার বর্ণনা গৌণ। সেবার গভীরে যে আত্মত্যাগ থাকে তার মহত্ব অনুভবের। চিত্তশুদ্ধির। কাকিমা যখন খাচ্ছেন, কাকু কাকিমার পিঠে ঠেসান দিয়ে বসে। আমরা কাকিমার সঙ্গে গল্প করছি। কাকিমা দুর্বল শরীরটার ভার কাকুর পিঠে দিয়ে কথা বলছেন। কোনো রকমে দু-এক চামচ মুখে নিয়ে পরের গ্রাসের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছেন। ননদেরা, মানে আমাদের পিসিরা বারবার ঘুরে যাচ্ছেন। কপট শাসন করছেন। বাইরে গিয়ে চোখের জল মুছছেন। কাকু একটু বেশিক্ষণ কোনো দরকারে ঘরের বাইরে গেলে বারবার খোঁজ নিচ্ছেন। ডাক পাঠাচ্ছেন। উনি তো জানেন প্রতিটা মুহূর্ত মহামূল্যবান এখন, চলে যাচ্ছে যে!

ভীষণ শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে…. তাকিয়ে দেখলেন সবাইকে… জিজ্ঞাসা করলেন, মায়ের কাছে কে আছে?

বৃদ্ধা শাশুড়ি আছেন নীচের ঘরে। স্মৃতিভ্রংশ মানুষটার কাছে কে আছে?

=====

পুরোহিত মন্ত্র পড়ছেন। সামনে কাকিমার সহাস্যমুখ ছবি। মালা দেওয়া। আমি কিচ্ছু নিয়ে যাইনি, না মালা, না মিষ্টি, না ধূপ। কার জন্যে নেব? কেউ যায়নি তো। মন্ত্রের মানে জানি না, কিন্তু এটুকু জানি তুমি আছ, এই কথাটা বলতেই আজ এত আয়োজন। সব শূন্য হলে যুক্তির চলে, হৃদয়ের চলে না। হিসাবের খাতা শূন্য হলেও হয়, কিন্তু ভালোবাসার খাতা শূন্য করবে কার সাধ্যি? মৃত্যু? সে পারে না। সমস্তটা জুড়ে এতবড় একটা "আছে" জন্ম নেয় যে, "নেই" শব্দটা এক কোণে পড়ে থাকে।

আমি মহাপুরুষ সে অর্থে দেখিনি কাউকে জীবনে। কিন্তু সংসারে এমন কয়েকজন মানুষকে অবশ্যই দেখেছি যাদের দেখলে বিশ্বাস জন্মায় মনুষ্যত্বে। ত্যাগ, তিতিক্ষা, স্নেহ, ভালোবাসা কোনো জঙ্গল, বা গুহাবাসী সাধকের একছত্র সম্পদ নয়, সংসারের নিত্য লড়াইয়ের ক্ষেত্রেও এমন রথীমহারথী জন্মায়, ভীষণ সাধারণ জীবনের আড়ালে, অসামান্য এক জীবন।

এ লেখা আমার শ্রদ্ধার্ঘ্য। ঋণ অনেক কাকিমা, শোধ হবে না, বোঝাও হবে না। জীবনের পাথেয় হয়ে থাকবে। আপনি যাননি কোথাও, যাওয়া যায় না। আমরাও যাইনি কোথাও, যাব না, যাচ্ছিও না। শোক একদিন শান্ত হবে। যেটুকু বাকি থাকবে, সে আপনার অস্তিত্বের মাধুর্য। যে মাধুর্য আজ অনন্ত, চিরন্তন হয়ে থাকল। থাকবেও।

প্রতিবার ফেরার সময় বলতেন, "আবার এসো"। সে ডাকে এক অধিকারবোধ ছিল। জোর ছিল। কোনোদিন ভোলার নয় সে ডাক। "আবার এসো"।