সুরদাস যখন যমুনার তীরে এসে দাঁড়ালেন তখন কালো করে এসেছে আকাশ। গতকাল সারারাত ঘুম হল না। বুকের মধ্যে এমন একটা কষ্ট জমাট বেঁধে থম ধরে ছিল, বুঝেছিলেন আজ বৃষ্টি হবে।
সুরদাস বসে আছেন যমুনার তীরে। বুকের ভিতর অভিমান। অভিমানের মেঘ। এ মেঘ বারবার আসে। নিজের অক্ষমতাকে নিয়ে ভীষণ অভিমান সুরদাসের। মনকে নিয়ে আর কত লড়াই করা যায়? মন তো না, যেন সহস্রনাগ। কালিয়ানাগ। তার হাজার একটা বাসনা। নিজেকেই নিজে দংশাচ্ছে। পাগল হয়ে যাবে সুরদাস। মনের নীচতা দেখে নিজের উপর নিজের বিতৃষ্ণা জন্মে যায় সুরদাসের। এত নীচ প্রভু, এত নীচ আমি। “মো সম কৌন কুটিল খলকামি”। নিজের মনকে কী না বলেছেন সুরদাস। বরাহের সঙ্গে তুলনা করেছেন। নিমকহারাম বলেছেন।
সুরদাস নিজের সঙ্গে নিজে লড়ে হেরে যায়। কিন্তু প্রভু হারেন না। সুরদাসের উপর তাঁর কী যেন এক কৃপা। এই নীচ মনেই এমন মাধুর্যের রস ঢেলে দেন, দিয়ে ইশারা করেন, বলেন, নাও সুরদাস, নাও। এ অমৃত। কী এই অমৃত? আমাতে তোমার এই বাসনা-কামনা-গন্ধহীন ভক্তি, এই তো অমৃত সুরদাস। গোটা সংসারে ভালোবাসা আর কামনা এক সঙ্গে জড়িয়ে। কামনাহীন ভালোবাসা কজন চায়? সে সাধন কী চায় সবাই?
সুরদাস বলেন, কিন্তু আমি কী এর যোগ্য প্রভু! আমি নীচ। অতি নীচ। আমাকে দেখো।
এমনই প্রভু সুরদাসের। তার মত কাঙালকেও সব তৃষ্ণাহরা ভক্তির আস্বাদন করিয়ে গেছেন। অহেতুক করুণায়। নইলে কী যোগ্যতা তার নিজের।
বৃষ্টি নামল। ধীরে ধীরে বৃষ্টির শব্দ বাড়ছে। অভিমান জমাট বাঁধা হয়ে আছে সুরদাসের বুকে এখনও। কিন্তু কেন? কেন পরম আমি পরম শুদ্ধতা চাইছি? সেও কী অহংকার নয়? আমি কী প্রভুর সামনে দাঁড়িয়ে বলব, দেখো আমি শুদ্ধবুদ্ধমুক্ত হয়েছি। আমার এমন আত্ম-বল! আমার স্বোপার্জিত ভক্তির পরাক্রম! আমি কী ভীষণ শক্তিশালী দেখো! এই কি দেখাতে চাইছি আমি প্রভুকে? নিজের সাধুতার গরিমা?
সুরদাসের প্রাণের মধ্যে ব্যথা জন্মাচ্ছে। আমি না হয় নীচ, আমি না হয় অতিকামী, আমি না হয় খল-কুটিল… কিন্তু আমি তো প্রভুর! এও তো সত্য। তাকে ছাড়া তো কিছুই জানি না আমি। সে যখন চাইবে আমাকে নিরবচ্ছিন্ন সুখে রাখবে। যদ্দিন না রাখে তদ্দিন এইভাবেই কাটুক দিন। ক্ষতি নেই। বরং প্রভুর ইচ্ছার বিপরীতে গেলেই বিপদ। আগেও তো দেখেছে সুরদাস।
সুরদাস বৃষ্টির শব্দে বিভোর। আশেপাশে গাছের উপর বৃষ্টির জল পড়ার শব্দ আচ্ছন্ন করে ফেলছে সুরদাসকে। সুরদাসের চিত্তজুড়ে এসে দাঁড়ালেন শ্রীরাধা। মুগ্ধ হয়ে দেখলেন সুরদাস। তারপর নিজের দুটো হাত সামনে বাড়িয়ে বৃষ্টির জল ধরলেন। শ্রীরাধার পা ধোয়াবেন। কাদা মাড়িয়ে এসেছেন তিনি। যমুনার তীর তো বৃষ্টির জলে কর্দমাক্ত।
সুরদাস অঞ্জলি অঞ্জলি জল নিয়ে পা ধুইয়ে দিচ্ছেন শ্রীরাধার। সুরদাস বাইরে দেখতে পান না। কিন্তু ভিতরে তো দেখতে পান। ভিতরে অন্ধ নিজেকে নিজে না করলে, বাইরে থেকে কেউ করতে পারে? নিজেকে দেখার দৃষ্টি প্রভু সবাইকে দেন। আমরা সেখানে অন্ধ সেজে বসে থাকি।
হঠাৎ এক জায়গায় দৃষ্টি স্থির হল সুরদাসের। শ্রীরাধার পায়ের একটা কোণায় কাঁটা বিঁধে। সুক্ষ্ম কাঁটা। সে কাঁটার মুখে জমাট বাঁধা রক্ত।
সুরদাস ব্যথিত মুখ তুলে তাকালেন শ্রীরাধার দিকে। নীরবে প্রশ্ন করলেন, কী করে হল স্বামীনী?
শ্রীরাধা হাসলেন। বললেন, তুমিই তো বিঁধালে, তোমার অভিমানের কাঁটা!
সুরদাস লুটিয়ে পড়লেন পায়ে। হা প্রভু! হা স্বামীনী! আমায় ক্ষমা করো… আমায় ক্ষমা করো….. সুরদাসের চোখের জলে ধুয়ে যাচ্ছে শ্রীরাধার চরণযুগল। সে কাঁটা বিঁধল সুরদাসের বুকে। লজ্জার কাঁটা। অভিমানমুক্ত হল সুরদাস। সব অভিমান যাক, তার তো একটাই অভিমান, সে প্রভুর।
কুটিরে ফিরছেন সুরদাস। সন্ধ্যে হয়েছে। পূর্ণচন্দ্র প্রফুল্ল শ্রাবণের আকাশে। মন্দিরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় পুরোহিত আটকালো পথ। সুরদাসের চরণ ছুঁয়ে বলল, এই শ্রাবণে যমুনাতীরে ডেকো না যখন তখন স্বামীনীকে। ভেজা শৃঙ্গার, কতবার বদল করি? এমনিই শ্রাবণমাস, শুকায় না শৃঙ্গার।
লজ্জার কাঁটা বিঁধল আবার সুরদাসের বুকে। কিন্তু তার হৃদয়ে তো বারোমাসই শ্রাবণমাস!