আশ্রমে ঢুকতেই দেখি গোঁসাই টোটোতে উঠছে, আমায় দেখেই বলল, যা রে তোর বিয়েবাড়ির বাস আর ছেড়ে যাবে না…
আমি অবাক হলাম। আমার তো কোনো বিয়েবাড়ি-টাড়ি নেই। বাইক স্ট্যাণ্ড করে বললাম, ব্যাপার কি?
গোঁসাই হাসল। তারপর টোটো চালকের পিঠে চাপড় মেরে বলল, আজ আমার নন্দবাবাজীর বন্ধুর বিয়ে। তা বরযাত্রীর বাস ছাড়বে সাতটায়, এদিকে আশ্রমে কিছু জিনিস না কিনলেই নয়, পলাশের জ্বর দুদিন ধরে, তাই আমি ওকে ডেকে বললাম আমায় একটু বাজারে ছেড়ে দিয়ে আয় বাপ…. ফেরার সময় কিছু একটা পেয়েই যাব…. এর মধ্যে তুই চলে এলি… ব্যস…নন্দ যাক বিয়ে বাড়ি, আমরা যাই বাজার…. তোর তাড়া নেই তো রে….
আমি হেসে বললাম, না।
====
তোর বাইকটা এত কাঁপছে কেন রে?
বললাম, আসলে শক অ্যাবজরবার বলে একটা জিনিস থাকে, ওটা জ্যাম হয়ে গেছে… তাই…..
গোঁসাই হো হো করে হেসে ফেলল।
আমি বললাম, এতে হাসার কি হল? তোমার কি কোমরে লাগছে? নামবে? তেমন হলে টোটো নিয়ে নিচ্ছি… রাস্তার যা দশা!
গোঁসাই বলল, আরে না… আমি ভাবছি তবে তোর জীবনে শক অ্যাবর্জরবারটি কি?
আমি হেসে বললাম, তুমি…. দেখো না তাই বাইরে ধাক্কা খেলে তোমার কাছে এসে গোত্তা খেয়ে পড়ি।
গোঁসাই হেসে বলল, ধুর, ওটা তো বাইপাস…. তোর গাড়ির ওই অ্যাবজর্বার বাইরে থাকলে কি আর চলত? আমি বড়জোর সার্ভিসিং সেন্টার হতে পারি…. যদিও কথাটা খাঁটি নয়… গোবিন্দই সব… তবু… কিন্তু অ্যাবজর্বারটি কি?
আমি বললাম, তোমার কি?
গোঁসাই বলল, আমার তোমার বলে কিছু হয় না রে। আমাদের সবার মধ্যেই একটা শক অ্যাবজর্বার দিয়েই ইঞ্জিনিয়ার পাঠায় রে…. কারোর বেশি, কারোর কম। এই যে ধাক্কা খেলে লোকে মন্দিরে, মসজিদে, চার্চে যায়…. গীতা, কথামৃত, কোরাণ, বাইবেল পড়ে মানুষ…. আসলে এগুলো তো এক ধরণের শক অ্যাবজর্বার।
বললাম, শুঁড়িখানাতেও তো যায়…
গোঁসাই হো হো করে হেসে বলল, ও তো পাশ কাটানো…. যেমন কষা পায়খানা হলে বাচ্চারা বলে, মা আমায় ঘুম পাড়িয়ে দাও… যেন ঘুমুলেই সে হাগা চলে যাবে!
গোঁসাই আবার হো হো করে হেসে উঠল। তারপর বলল, আসলে ধাক্কা খেয়ে মানুষ যখন যুক্তি রাস্তা হাতড়াচ্ছে, তখন মানুষ একটা সঙ্গত বিশ্বাসের রাস্তা খোঁজে। সেই রাস্তাটাই ওই শক অ্যাবজর্বার। বুঝলি?
আমি বললাম, রবীন্দ্রনাথ বোধায় বাঙালির সব চাইতে বড় শক অ্যাবজর্বার তবে?
গোঁসাই দিগন্ত কাঁপিয়ে হো হো করে হেসে উঠল…. বলল, মেগা শক অ্যাবজর্বার।
আমিও হাসলাম।
গোঁসাইকে জিজ্ঞাসা করলাম তোমার?
গোঁসাই উত্তর দিল না। দিগন্তে ডুবছে আজকের সূর্য…. একই সূর্য, তবু রোজ নতুন… কি আশ্চর্য…. আমার কাঁধে গোঁসাইয়ের হাত। আমার কান্না পেয়ে যাচ্ছে। কেন জানি না। আমি নাস্তিক, না আস্তিক কিচ্ছু বুঝি না। গোঁসাই বলে ওসব ভুল শব্দ। ভালোত্বে বিশ্বাস করলেই আস্তিক। অবশেষে সবাই ভালোটাই তো চাই… ভালো মুচি, ভালো মাস্টার, ভালো জজ, ভালো চিকিৎসক, ভালো বন্ধু…. সব ভালো জড় করলে হয় ভগবান….
কি গো, বললে না গোঁসাই…..
গোঁসাই বলল, রামকৃষ্ণ ঠাকুর কি বলেন জানিস তো…. ঝড়ের পাতা হয়ে থাক…. এই যে বসন্তে ঝরা পাতা… কেমন উড়ে উড়ে যাচ্ছে বল…. হাওয়া যেদিকে নিয়ে যাচ্ছে সেদিকে…. ঠাকুর বলতেন তাই, ওরে ভাই দাঁড়টাড় বেয়ে টেয়ে নিয়ে, হাত ব্যথা করে পাল তুলে দে। শরণাগত হ…. হে গোবিন্দ রাখ শরণে……
গোঁসাই গুনগুন করে গাইছে।
গান শক অ্যাবজর্বার। কবিতা শক অ্যাবজর্বার। ভালোবাসা শক অ্যাবজর্বার। দুটো ভালো কথা, হাসি, স্পর্শ শক অ্যাবজর্বার। নইলে চলে কি করে মানুষ! পালিয়ে যাওয়ার তো পথ নেই…মুখোমুখি হওয়ার সাহসও নেই…. তবে?
গোঁসাই বলল, কারোর একটা হাত ধরা লাগে….
কার হাত ধরবে মানুষ গোঁসাই?
যে হাত ধরলে মনে শান্তি আসে, সাহস আসে।
যেমন?
যেমন ফুলের সুগন্ধ বাতাসের হাত ধরে…..