Skip to main content

 

মন ইডলিতে একটা কামড় বসিয়ে ট্রেতে রেখে দিল। আঠারো বছরের মোবাইলে ডোবা ছেলের হাতে টোকা দিয়ে ইশারা করল - ওঠ।

চেয়ারটা টেবিলের নীচে ঢোকাতে ঢোকাতে ঘড়ির দিকে তাকালো - চারটে পঞ্চাশ। রেস্টুরেন্ট থেকে গাড়ি অবধি যেতে পাঁচ মিনিট তো লাগবে। আর পাঁচ মিনিট বেশি হলে পাঁচশো টাকা বেশি চার্জ করবে গাড়ি। সাগ্নিক অসন্তুষ্ট হবে।

মন রেগে যাওয়াকে ভয় পায় না, অসন্তুষ্ট হওয়াকে ভয় পায়। অসন্তোষ কালিয়ানাগের মত। সহস্রফণা। কোন দিকে কোন বিষ ঢালে কে জানে।

মন সাগ্নিকের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, চলো।

======

গাড়িতে বসে মাথাটা সিটে এলিয়ে দিয়ে শুলো মন চোখটা বন্ধ করে। হাওড়া স্টেশানে বসা বাচ্চাটার কথা মনে পড়ছে। বাচ্চাটার বাবার কী অসুখ। ওরা ভেলোর যাচ্ছে। লোকটা রাজমিস্ত্রীর কাজ করে। বাচ্চা মেয়েটাকে মা বকছে, তুই কেন ওই চিপ্সটা কিনলি? জানিস না বাবার কদ্দিন কাজ নেই, ডাক্তার দেখাতে কত টাকা লাগবে…তার চাইতে একটা বিস্কুটের প্যাকেট কিনলে সবাই পেত একটা করে।

মন বাচ্চাটার দিকে তাকালো। ছয় সাত বছরের মেয়ে। লাল ফ্রক পরে। চেহারাটা বয়েস আন্দাজে ভারী।

মেয়েটার বাবা বলল, ছাড়ো না, খাওয়া নিয়ে কথা বলো কেন…..

মা বলল, বলব না?….মোটা হচ্ছে দেখছ…এরপর সামলাতে পারবে?.....আর বুঝবে না-ই বা কেন….গরীবের ঘরে জন্মেছে….অত খাওয়া কী?

মেয়েটার চোখের কোলে জল। মন অন্যদিকে তাকিয়েছিল।

======

মনের গা গুলাচ্ছে। কফিটার বাজে ঢেকুর উঠল। সাগ্নিক পাশে বসে ল্যাপটপ খুলে। বাবু সামনে ড্রাইভারের পাশে, মোবাইলে ডুবে। মন ব্যাগ খুলে প্লাস্টিকটা বার করল। সাগ্নিক বলল, গাড়িটা দাঁড় করাব?

মন বলল, থাক।

ওয়াক আসছে। তার সারা শরীরে ক্যান্সার ছড়াচ্ছে। ভীষণ তাড়াতাড়ি ছড়াচ্ছে। রুগ্ন মানুষের শ্লাঘা খসে যায়। মৃত্যুর আগেই জীবন নিয়ে শ্লাঘা খসে যায়। নির্ভরশীল মানুষের আবার শ্লাঘা কিসের। যখন তখন করুণা, যখন তখন শ্লেষ, অপমান, তিরস্কার। খুব স্থূলভাবে ভাবছে?

বমি হল না। কিন্তু গা গুলানোটা থেকেই গেল। বড় অস্বস্তিকর অনুভব। বিয়ের পর পরও মনে হত তার সারাদিন যেন গা গুলাচ্ছে। তাদের অ্যারেঞ্জড বিয়ে ছিল।

=====

চেন্নাই শহরে অসুস্থ হওয়ার আগে এসেছে একবার। সাউথ ট্যুরে। বাবা মায়ের সঙ্গে। বাবা মা এখন ওপারের আত্মীয়। ডাকছে মনকে। মন একা যাবে। সংসার ফেলে যাবে। যেতেই হবে। ভয় নেই। আফসোস আছে। অপরাধবোধ আছে। কীসের জানে না। কিন্তু আছে। জানে। কেউ যেন রোজ ঘুমের সময় তার মাথার কাছে রেখে যায় - আফসোস, অপরাধবোধ।

======

হোটেলে এসে বমি হল। এখন একটু স্বস্তি লাগছে। সাগ্নিক ছেলেকে নিয়ে ডিনারে বেরিয়েছে। তাছাড়া বাবুর একটা জিন্স কিনতে হবে।

মন ফোনটা সুইচ অফ করে দিল। কিছুক্ষণ বিনা করুণা, বিনা তাড়না কাটাতে চায়। জড়ের সঙ্গে। এই দেওয়াল, এই ছাদ, বাথরুমের কল, কমোড, বালতি এরা শ্লাঘাহীন। তার মত। সুস্থ স্বাভাবিক মানুষদের অজ্ঞাতে একটা শ্লাঘা কাজ করে। সে জানে সে সব করতে পারে, এমনকি চাইলে মরতেও পারে। গোটা জীবনটাই যেন তার চয়েস। কী মিথ্যা না? প্রতিদিন যারা হাওড়া স্টেশানে নামে, কাজে যায়, তারা বিশ্বাস করে তারা চাইলেই যেখানে খুশি চলে যেতে পারে। ইচ্ছা করলেই। শ্লাঘায় এত বিশ্বাস তাদের। এ অন্ধবিশ্বাস। ঘোর অঅন্ধবিশ্বাস। কেউ কোথায় যায় না, সন্ধ্যেতে আবার ক্লান্ত হয়ে বাড়ির ট্রেন ধরে, একটা বসার জায়গা পাওয়ার জন্য হাপিত্যেশ করতে করতে ভাবে, চাইলেই সে যা খুশি করতে পারে, যেখানে খুশি চলে যেতে পারে, এমনকি হারিয়েও যেতে পারে।

কিন্তু অসুস্থ মানুষের কোনোটাই চয়েস না, এমনকি মৃত্যুটাও না। সেটা অপরিহার্য। তাই শ্লাঘাহীন।

=======

মন এসিটা কমালো। জানলার পর্দাগুলো টেনে দিল। জীবন যেন একটা হল্ট স্টেশানে বসে। কোনো ট্রেন দাঁড়ায় না। অথচ শুনেছে একটা দুটো ট্রেন নাকি দাঁড়ায়। তারা কোন ট্রেন?

মন গভীর ঘুমকে ভয় পায়। গভীর ঘুম থেকে উঠলেই অভ্যাসবশত পুরোনো সুস্থ জীবনের শ্লাঘাটা ফিরে আসে। পরক্ষণেই মনে পড়ে সকালের এই রোদ, এই পাখির ডাক তার জন্য নয়। বিচ্ছিরি ভার ভার লাগে সব।

=====

নয়নের মায়ের কথা মনে পড়ছে। কোমর ভেঙে বিছানায় পড়ে পড়েই মরে গেল। নয়নদের খাটাল ছিল। দুধ নিতে যেত মন বাবুর জন্য। নয়নের মায়ের সঙ্গে কত গল্প হত। একদিন সে বর্ষাকালে গোবরে পা পিছলে কোমর ভেঙে পড়ল। সে নাকি কোমর ভেঙে অনেকক্ষণ পড়েছিল। কেউ খেয়াল করেনি। মন ভাবে গরুগুলোর পায়ের কাছেই তো পড়েছিল, লাথি মারেনি ওরা? গরুদের শ্লাঘা থাকে না? শ্লাঘা কি জৈবিক, না মানসিক?

নয়নের মাকে মন দেখতে যেত প্রথম প্রথম কয়েক মাস। তারপর একদিন ভুলেই গেল নয়নের মায়ের কথা। মনে পড়ল যেদিন মারা গেল নয়নের মা। সেদিন সপ্তমী ছিল। মনের মনে পড়ছে নয়নের মায়ের বিছানার পাশে যখন বসে থাকত নিজের সুস্থতার জন্য শ্লাঘা হত নিশ্চয়ই? নইলে করুণা করবে কী করে? হত হয় তো।

======

মন চুপ করে শুয়ে নিজের বুকের আওয়াজটা শুনছে। হৃদয় খুঁড়ে অবিনশ্বর ঈশ্বরকে ডাকছে। কেউ নেই। সে ছাড়া গোটা বিশ্বসংসার অবিনশ্বর। কী ভীষণ অন্ধকার। একটা টিকটিকি টিউবের পিছনে মাথাটা বার করে আছে। শিকার ধরবে।

উপুড় হয়ে বালিশে মুখটা গুঁজে মন নিজের দম আটকানোর চেষ্টা করল। হাঁপিয়ে উঠে বসে পড়েই মনে হল একবার টয়লেটে যেতে হবে।

========

টয়েলেটে দরজা বন্ধ করল না। কিন্তু কমোডে বসতেই কলিংবেল বাজল। একবার। কয়েক সেকেন্ড বন্ধ। আবার। কয়েক সেকেন্ড বন্ধ। আবার।

বুকের ভেতটা ধড়াস ধড়াস করছে মনের। সাগ্নিক কী রেগে আছে? বাবু কী চীৎকার করবে? মাথাটা বিবশ হল। যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব, আর নিজেকে যতটা গোছানো সম্ভব গুছিয়ে দরজার কাছে গেল। দরজার বাইরে আর ভিতরে মেয়েদের দু ধরণের সম্ভ্রম। মন আপ্রাণ চেষ্টা করে নিজেকে দু হাতে রক্ষা করতে। এইভাবে সে নিজের পরিবারের মান রক্ষা করে। সমাজের আব্রু রক্ষা করে। সবটাই খেলা এখন। কিন্তু খেলা ছাড়তে মন চায় কই?

======

লণ্ড্রির ছেলেটা দাঁড়িয়ে। মনের হাতে প্যাকেটটা দিয়ে তাকালো। কৌতুহলে করুণা মিশলে যেমন হয়। টাকা দেওয়া আছে বলল। যেন টাকা দেওয়ার অযোগ্য সে, মনে করালো।

বিছানায় প্যাকেটটা রেখে মন মেঝেতে বসে পড়ল। এত ভয়, এত আতঙ্ক কীসের তার? কেন? বাইরের দরজাটা খোলা। বাইরে যাবে? একা? কদ্দিন যায়নি তো। যাবে? কোথাও না, এই সামনের গলিটার মোড়ে একটা দারুণ শাড়ির দোকান দেখেছে। যাবে? কিনবে না। দেখবে শুধু। পোশাকের মধ্যে শ্লাঘার আদি নিবাস। পোশাক দেখেই তো মানুষ ঠিক করে কার শ্লাঘা কোন রেশমে বোনা।

=====

কত প্রশ্ন। কত সংশয়। মাথায় ভিড় করে আসছে। হঠাৎ আলোতে অবাঞ্ছিত পোকার ভিড়ের মত। কোন শাড়িটা পরে বেরোবে। আদৌ ঠিক মত পরতে পারবে কী? যদি রাস্তায় মাথাঘোরে। যদি বমি পায়। যদি সত্যিই কোনো শাড়ি পছন্দ হয়ে যায়। সব চাইতে ভয় হল, যদি ভুলে যায় তাকে এসব ছেড়ে যেতে হবে। কী করবে তারপর সে? যাবে, না যাবে না? শ্লাঘা মরেনি তবে? এই তো...বিন্দু বিন্দু বৃষ্টি শেষের পাতা ঝরা জলের মধ্যে পড়ছে বুকের মধ্যে। এই তো। এই তো।