কলিংবেল বাজল। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে যিনি তিনি চেনা মানুষ। অনেক বয়েস। গৃহবন্দী হয়ে থাকেন প্রায়। আরো ভালো করে বললে বিছানাবন্দী।
দরজা খুলেই হাতটা ধরলাম। চোখে হাইপাওয়ারের চশমা। সে চশমার ভিতর দিয়ে চোখটা অত্যন্ত স্ফীত। যতটা উনি দেখতে পান, চোখ তার চাইতে অনেক বেশী স্ফীত। কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, তোমার বাবাকে দেখতে এসেছি একটু… মনটা কেমন করছিল।
বাবা তো দোতলায়। তিনিও তো শয্যাশায়ী। উঠবেন কি করে?
পারব পারব… তুমি হাতটা ধরলে পারব।
গলা কাঁপল। শুধু বয়েসের ভারে ক্লান্ত দুর্বল স্বরযন্ত্রের জন্য নয়, আবেগেও।
হাতটা শক্ত করে ধরে এক পা, এক পা করে নিয়ে উঠছি সিঁড়ি দিয়ে। ওঁর হাঁফ ধরে যাচ্ছে। হাতটা শক্ত করে ধরে আমার। বলছেন, শ্বাসটুকু একটু জমলেই বলছেন, তোমরা ছাড়া কে দেখবে আমাদের বলো?
বললাম, আছি তো জেঠু। আছি।
বাবার ঘরে ঢুকলেন। বাবা নিজেকে কোনোরকমে বসিয়ে হাতটা বাড়িয়ে দিলেন। উনিও এগিয়ে গিয়ে হাতটা ধরলেন।
"কবে চলে যাই ভটচাযদা… একটু দেখা করতে এলাম… বিজয়া পেরিয়েই… শরীরটা আজ একটু ভালো…."
দু'জন বৃদ্ধ মুখোমুখি বসলেন। ফেলে আসা কথা না। পেনশান, গ্র্যাচুইটি, রাজনীতির কথা না। চলে যাওয়ার কথা বলছেন। প্রস্তুতির কথা বলছেন।
আমার মনে পড়ল এই ক'দিন আগের কথা। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে। এক উদ্বাস্তু কলোনিই বলা চলে। একজন বৃদ্ধ, এক বৃদ্ধাকে বলছেন, হাত-পা নড়াচড়া করতে করতেই চলে গেলে ভালো জানবেন… নইলে বিছানায় শুয়ে এর ওর লাথিঝাঁটা খেয়ে বেঁচে থাকার কোনো মানে নেই… ও শাস্তি.. এই যে চলে ফিরে বেড়াতে পারছেন… এই জীবনের সব থেকে বড় সুখ… অমুকের মা-কে দেখতে গেলাম। হেগেমুতে শুয়ে থাকে। আমায় দেখেই বললেন, ঠাকুরমশায় আমার মরণ কেন হয় না?
ঠাকুরমশায় উনি। কারণ দিনের শেষে মন্দিরের আলোয় খেটে-খাওয়া মানুষগুলো ওঁর কাছে ভাগবত শুনতে আসে। আমিও শুনেছি। কিছুক্ষণের মধ্যে ঈশ্বর মিশে যান দৈনন্দিন জীবনের ধারাপাতে। সুখদুঃখের গল্পে ভাগবতের ব্যাখ্যা জমে ওঠে। সে কোনো শাস্ত্রকারের ব্যাখ্যা না। সে রোদজলে খেটে খাওয়া মানুষের ব্যাখ্যা। জীবনের মানে তাদের মত করে।
এইবার উনি ফিরবেন। হাতটা ধরে, শরীরটা বেড় করে ধরে এক পা, এক পা করে নামাচ্ছি। বারবার বলছেন, বাবাকে দেখো। বাবাকে দেখে রেখো।
রাস্তায় এসে বললাম, চলুন এগিয়ে দিয়ে আসি।
আপত্তি করলেন না।
রাস্তায় ছড়িয়ে কারোর বাড়ির বাগানের শিউলিফুল। উনি দেখলেন না। উনি আর কিছুই মন দিয়ে দেখেন না। মানুষ খোঁজেন। হাতটা ধরার। আশ্বস্ত করার, আমি আছি।
বাড়ি দিয়ে ফিরছি। রাস্তায় ছড়ানো শিউলিফুল হারিয়ে যাবে খানিকবাদে। সব হারিয়ে যায়। এক শরতের শিউলি আরেক শরতে আসে না। এই আসা আর চলে যাওয়ার মধ্যে কিছুক্ষণ হাতের উপর হাত চাওয়ার আকুতি। এইটুকুই যা আছে। বাকিটা কি? জানি না তো।