সব জানলাগুলো বন্ধ। বুকে জমা কফের আওয়াজ ঘড়ঘড় করে যাচ্ছে। আগের থেকে ভালো।
কৃষ্ণচূড়া গাছটার তলা ভরে গেছে ফুলে?
ঘুমের ওষুধ আরো দু’দিন চলবে। প্রেসার, সুগার, থাইরয়েড - আছে আরো চারদিনের মত। জিভে স্বাদ নেই। সারা শরীরে ওষুধের গন্ধ। জামাতে, বিছানায়, ঢেকুরে, হিসিতে।
স্টেশানে নেমেই ডানদিকের মিষ্টির দোকানে এই, ঠিক এই সময়ে জিলিপি ভাজা শুরু হয়। সিঙ্গাড়া। ছেলেটা হিসাবে ভুল করে। ইচ্ছা করে?
ইনসুলিনের ইঞ্জেকশন। দাও। ক্যাথেটার, শরীরের গভীরতা ছুঁয়ে। শরীরের অংশ এখন। আত্মীয়। গলা শুকাচ্ছে। মাপা জল। তাই দাও। শরীর বর্ষার রাস্তার মত, যেখানে সেখানে জল জমিয়ে এখন। যাব তো। সময় হয়নি। গাড়ি আসার ঘোষণা হয়েছে খালি। কত নাম্বার প্ল্যাটফর্ম, জানো কিছু?
পুজোর আগে আগে। এই বাজারগুলোতেই কি ভিড়। এখন কি ফাঁকা, ফাঁকা? না? লোক হয় না প্রচুর? শপিং মল। গেছি কয়েকবার। সিঁড়ি ভেঙে উঠতে গিয়ে হাঁটু টাটিয়েছে। একতলায় মুদি। দোতলায় বাচ্চাদের। তিনতলায় মেয়েদের। চারতলায় ছেলেদের। কত বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়ে। কাছে আসছে। খদ্দেরের ইগো ভোলানো হাসি রপ্ত করেছে কেউ কেউ। কেউ পারেনি। শুকনো মুখ। লড়াই করছে। ইগোর সঙ্গে আত্মসম্মানের রফা চলছে। পোশাক বদলাবার ঘরে কত মানুষের ঘামের গন্ধ। আয়নায় নতুন পোশাকে নিজেকে দেখেছি। না কিনেই। আশ্চর্য লেগেছে! আমার এই পরা খোলা জামা আবার কেউ এই ঘামের গন্ধ ভরা ঘরে এসে পরবে, নিজেকে বলবে, মানালো? নিজেকে সুন্দর লাগে। মুখে বলা যায় না। শপিংমলের আয়না জানে, কত মানুষের গোপন আত্মরতির সাক্ষী সে। মনে মনে কি বলে সে? বেহায়া?
ঘুম আসছে না। কত বাড়ালে ডোজ? আর কতই বা বাড়াবে? তোমরা ঘুমাচ্ছ। ঘুমাও। কারশেডে ঢোকার আগে ক্লান্ত ট্রেন ফেলে আসা রেললাইনের গল্পকে কাছে ডাকে, বলে চল। আমার অনেক গল্প। কোনো ক্লাইম্যাক্স নেই। কোনো মাথামুণ্ডু নেই। কেউ শোনারও নেই। লোহিত রক্ত কণিকা নাকি বাঁচে একশো কুড়ি দিন। না বলা গল্প বাঁচে কদ্দিন? সারা শরীর ঘুরে ঘুরে, হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে? মানুষ নাকি দু’বার জন্মায়। বাজে কথা। কতবার যে জন্মায়। ভালোবাসায়, না-ভালোবাসায়। পাশাপাশি শোয়া দুটো নগ্ন শরীরের দূরত্ব কি অসহ্য! যেখানে ভালোবাসার মুখোশ পরে শরীরের কাছে সুখের ভিক্ষা চাইতে এসেছে খিদে।
খিদে বলতে মনে পড়ল, এখনো মানুষ ডাস্টবিন থেকে খাবার খোঁজে? দেখেছ? আমি দেখেছিলাম। তারপর থেকে বুঝতে পারতাম না হোটেলের থালায় রাখা খাবার রেখে যাব, না বাকিটা খেয়ে নেব? যদি ডাস্টবিনে ফেলে আমার এই আধখাওয়া মাংসের লেগপিসটা, কিম্বা এই ফিস কাটলেটের অর্ধেকটা… কে পাবে আগে? মানুষ, না কুকুর? পৌরসভার চলন্ত ডাস্টবিনে কুকুর ওঠে না। চারপাশে চারটে জানলা দিয়ে মানুষ হাত বাড়ায়। খাবার খোঁজে। ভালো করে দেখো, এখনও খোঁজে।
স্নান করাবে আজ? পায়খানা? হচ্ছে না। পেটটা পাথরের মত। শক্ত। খোসার মত ছাড়িয়ে সব। পচে যাচ্ছি। গন্ধ পাচ্ছ জানি। আমার শরীর জুড়ে পচনের গন্ধ। আমার ঘরে সাজিয়ে রেখেছ কত সুগন্ধী। ওগুলো কিগো, আতর? রাজস্থানে কিনেছিলাম, যোধপুর থেকে। ছোটো ছোটো শিশিতে। কি দাম! এগুলো কি তার চেয়েও দামী? পচনের চেয়ে কত?
পর্দা টেনো না। আরেকটু দেখি দিনের আলো। রাস্তায় বাচ্চাগুলোর চীৎকার, হুল্লোড় আরো কদিন শুনি। বাতাস আসুক। ঠাণ্ডা লেগে যাবে? কাশব সারারাত আবার? বেশ বেশ। বন্ধ করো সব। রোদ বাতাস… আমার আসলে আর কিছুতেই কোনো অধিকার নেই।
গীতা?
থাক। আজীবন ঈশ্বরকে বড় বিব্রত হতে দেখেছি। অপরাধীর মত পুজো নিচ্ছেন, আর বলছেন, পারব না, পারব না…. বর্ষার মেঘকে শরতের মেঘ বানাতে জানি না আমি… আমি সূর্যের কক্ষপথ জানি না বদলাতে… আমি… বোঝো না কেন সব শূন্য অবশেষে… শূন্যের কাছে দাবী নেই কোনো, শূন্যকেই জেনেছি… একজন নিরীহ সৎ মানুষের মত ঈশ্বরকে দেখেছি ভাঙা ল্যাম্পপোস্টের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে কাঁদতে। একা।
সরে যাও তোমরা। এই কাছাকাছি থাকার আবদার বন্ধ হোক। হাত সরিয়ে নাও।
কি ধূপ জ্বেলেছ গো? শাঁখ বাজছে কোথাও… সন্ধ্যে নামছে। একটা আবদার রাখবে? ঘাসের উপর একটু পর পড়বে শিশির। তোমরা কেউ একজন হাতে করে মেখে আনবে? দেবে আমার হাতে, গালে, পায়ে মাখিয়ে? পুড়ে যাওয়ার আগে এই আমার শেষ ইচ্ছা। একবার হাতে পায়ে গালে লাগুক শিশির। শিশির বড় স্বর্গীয়, নিরভিমানী। আমায় এনে দেবে?