Skip to main content

সূর্য তো ওঠে ডোবার জন্যেই। এই যে শিমুলফুলগুলো মাটিতে পড়ে, ধুলোয় মাখামাখি, ফুটেছেই তো ওইজন্যে। মানুষ জন্মায়ও তো…..

কারোর খেয়াল করার কথা নয় যে জনার চোখের কোলটা চিকচিক করে উঠেছে পশ্চিমের সূর্যের আলোয়। জনাইয়ের বয়েস ছাব্বিশ। বউটার আঠারো। গতকাল "মরেছে"।

জনা বর্ধমানে ঠিকে শ্রমিকের কাজে এসেছে। ঝিলের ধারে পাঁচিল বানানোর কাজ। ইট এসেছে গতকাল। ডাঁই করে রাখা। ঠিকেদার বলেছে, "জলে ভেজা ইটগুলো জনা"।

পাইপে করে জল এনে ইট ভেজাচ্ছে জনা। গতকাল এই সময়ে ফোন এসেছিল, "বউটা মরেছে তোর, চলে আয়"। পোয়াতি ছিল। শরীরে রক্ত ছিল না। মরবে জানতই জনা। বাড়ি যায়নি। বলেছিল, আসছি। যায়নি।

বুকটা মাটি কাটার মত কোপাচ্ছে। কি হবে যদি যেত? মড়ামুখ দেখতে অদ্দূর যায় কেউ? ফেলে তো রাখবে না! অতগুলো বাচ্চা বাড়িতে। গন্ধ ছড়াবে না?

জনা বলল, জল শেষ!

ঠিকেদার বলল, পাইপটা গুটিয়ে রাখ।

এরা কেউ জানে না এ সব। দরকার নেই। ঠিকেদার ঠাকুরদেবতা ধম্মোকম্ম করে খুব। অবশ্য মেয়েছেলের দোষও যে নেই তা নয়। বউ মরেছে শুনলে শালা এখনই খাওয়া-দাওয়া নিয়ে ক্যাঁচাল করবে। থাক।

=======

কাজ শেষ হতে হতে রাত্রি আটটা বাজল। আজ শিবরাত্রি। ঠিকেদার, সোমনাথদা আজ সবাইকে নিয়ে যাবে গঙ্গার ধারে কোন মন্দিরে।

একটা ম্যাটাডোর ভাড়া করে চলল সব। দু-চারজন উপোস করে আছে। সোমনাথদা তো জলও ছোঁয়নি সকাল থেকে।

ম্যাটাডোর গঙ্গার ধারে একটা বড় বটতলায় এসে দাঁড়ালো। সবাই নামল। মাইক বাজছে। আলো দিয়ে সাজানো চারদিক। খুব ভিড় না হলেও লোক এসেছে বেশ। মেয়েছেলেই বেশি। অনেকেই চান করে উঠছে গঙ্গা থেকে। ভিজে শাড়ি। সারাটা শরীরকে সাপের মত জড়িয়ে। জনার মনে হল অন্ধকারে কোথাও যেন দাঁড়িয়ে আছে জবা। তার বউ। পাশে যেন বাচ্চাটাও। তাকে দেখছে।

সোমনাথদা গঙ্গার দিকে চলে গেল। সোমনাথদার সঙ্গে বাকিরাও। অলোকদা জ্বর নিয়েই চলে গেল। ভালো মিস্ত্রি। নেশায় ডুবে থাকে। সোমনাথদা বলে, খুব তাড়াতাড়ি মরবে ও। লিভার পচে।

জনা অন্ধকারের দিকে এগিয়ে গেল। তাকে টানছে জবা, তার বাচ্চা। কি হয়েছে ছেলে, না মেয়ে? মেয়ে মেয়ে। চোখে কাজল পরানো ওই তো। হলুদ ফ্রক।

আরে কাকে দেখছে? একটা বাচ্চা ঠাকুমার হাত ধরে পায়ে পায়ে বটতলার দিকে এগোচ্ছে। তার হলুদ ফ্রকে প্রজাপতি আঁকা।

এই জনা….

অলোকদা'র গলা।

জনা তাড়াতাড়ি গঙ্গার দিকে গেল। অন্ধকার। তাও যেন সব দেখা যাচ্ছে। অন্ধকারেরও আলো থাকে। জনার মনে হল জলের নীচে পা আঁকড়ে জবা। জনা ডুবল। বুকের ভিতর কাটা মাছের ছটফটানি। বাচ্চাটা তার কাঁধে, বাবা, বাবা, পাঁপড়….

পাড়ে দাঁড়িয়ে হলুদ ফ্রক বাচ্চাটা। তার বাবা, রিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে। বাচ্চাটা আঙুল দিয়ে দোকানে ঝোলানো পাঁপড় দেখাচ্ছে।

ডুব দিল জনা। মুখের মধ্যে জল ঢুকল। নাকে জল গেল। বিষম লেগে গেল। কাশতে কাশতে পাড়ে উঠে এলো।

অলোকদা বলল, জনা বিড়িটা কম খা একটু….

সোমনাথদা বলল, শালা কারে কে জ্ঞান ঝাড়ে….

=======

ছোটো ছোটো প্লাস্টিকের ঘটি পাওয়া যাচ্ছে। সবাই কুড়িটাকা দিয়ে জল, ধূপ, মোমবাতি, ফুল কিনছে। লাইন দিয়ে যাচ্ছে। শিবের মাথায় জল দিচ্ছে।

জনাও কিনল। আকাশের দিকে তাকালো। এতক্ষণে ছাই হয়ে বাতাসে মিশে গেছে জবা, আর তার মেয়ে… কি নাম? শিমুল? ওই যে ধুলোয় পড়ে… ওই যে লাল টুকটুকে ফ্রক পরে মাটিতে শুয়ে। ওই তো ওর মেয়ে। শিমুল। জনা চোখ বন্ধ করল। তার মুখেচোখে মিশে যাচ্ছে জবা আর শিমুলের ছাই। জনার বুকের ভিতর মশলামাখার বড় হাঁ-মুখ যন্ত্রটা, হাঁ হাঁ করে গিলে নিচ্ছে জনাকে। গড়গড় আওয়াজ হচ্ছে।

তার ভেজা ধুতিতে টান লাগল।

জনা ফিরে তাকালো। হলুদ ফ্রক মেয়েটা। তার দিকে তাকিয়ে। তার হাতে টাকা ধরা। বলল, তুমি ফেলে এসেছিলে… মা পাঠালো….

জনা তাকালো। তার মা'ই দোকানে বসে। জনা হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। একহাতে জল, আরেক হাতে ওকে কোলে তুলে নিয়ে মায়ের কাছে গেল…. বলল, এই টাকাটা দিয়ে ওকে কিছু কিনে দেবেন?... আসলে ওর বয়েসী আমারও একটা মেয়ে আছে…. গ্রামে…. শিমুল….

দোকানে তখন অনেক ভিড়। সে শুনল কি শুনল না…. টাকাটা নিয়ে হাসল… বলল, আচ্ছা…..

জনা জলের জায়গাটা নিয়ে এগোচ্ছে। কাঁধে বসে শিমুল, জবা সামনে সামনে হাঁটছে। গঙ্গাস্নান করেছে সে-ও। ভিজে কাপড়ে যাচ্ছে। শিমুল হলুদ ফ্রক মেয়েটার দিকে আঙুল দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ও কে বাবা?

জনা বলল, তোর বোন….

কি নাম?

জনা বলল, এই যা নাম তো জানি না….

শিমুল বলল, আমি জানি…পারুল….

=======

পরেরদিন শেষরাতে যখন জনার ঝুলন্ত শরীরটা শিমুলগাছের ডালে অলোক দেখল, প্রথমে চিনতেই পারেনি। নেশায় চুর তখন সে। ভেবেছিল মহাদেব। ধুলোয় শুয়ে প্রণামও করেছিল। চারদিকটা একটু পরিষ্কার হতে যখন বুঝল জনা….

খেয়াল করেনি তার কাঁধের উপর পড়ে একটা শিমুলফুল।