সৌরভ ভট্টাচার্য
27 August 2016
গত দু'দিন ধরে ফেসবুকে দুটো পোস্ট অনেকবার চোখে পড়ল।
এক, একজন 'তসলিমাপক্ষ' লিখছেন, তিনি নারী বলে কেন বুক খোলা রাখতে পারবেন না ইত্যাদি পুরুষদের মত।
দুই, একজন স্বামী তার মৃতা স্ত্রী'র দেহ কাপড়ে জড়িয়ে দশ কিলোমিটার নিজের মেয়ের সাথে হেঁটে গ্রামে ফিরেছেন, কারণ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে এম্বুলেন্সের টাকা দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না বলে।
আমি কোনো তর্ক-বিতর্ক করার জন্যে এ পোস্ট লিখছি না। বড্ড ভারাক্রান্ত লাগছে। দুটো পোস্টের একত্রীকরণ হওয়াটা সম্পূর্ণ কাকতলীয় জানি। তবু ভাবি ভারতবর্ষ কতটা ব্যবধানে পাশাপাশি হাঁটে। কত দূরত্ব এক প্রান্তের সাথে আরেক প্রান্তের। কালাহান্ডির ঘটনা। সেখানে বহুবার গেছি। দেখেছি আদিবাসী মেয়েদের বুকের আবরণ নিয়ে সত্যিই ওদের কোনো মাথাব্যথা নেই।
ঘটনা মর্মান্তিক। কারোরই কোনো কথা দিয়ে এ পাপ ধোয়া সম্ভব না। শুধু নিজের কথা ভেবে অবাক হচ্ছি। কতটা পিছিয়ে আছি এখনো মানসিকভাবে। মনুষ্যত্বের জয়গান কানে ব্যঙ্গ করে ফিরছে। যে মেয়েটা তার বাবার সাথে কেঁদে কেঁদে ফিরছিল, তার মতন অবস্থা তো আমারও একদিন হয়েছিল। পার্থক্য ছিল সেদিন আমার পাশে বহু বন্ধু-আত্মীয়স্বজন ছিল, আর আমার গাড়িতে করে মা'কে শেষবার নিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য ছিল। কিন্তু শোক আর যন্ত্রণায় কি কোনো ফারাক ছিল? কম খেতে পেলে, কম সুযোগ সুবিধা পেলে নিউরোনের সংখ্যা কমে যায় কি? জানি না। মানুষ হিসাবে তো একটা মানুষকেই অনুভব করতে পারি। তার বেশি তো পারি না। পশুপাখি, গাছপালা যার উপরেই মানুষের মায়া এসেছে তাকে সে নিজের মত করেই অনুভব করেছে, তাই একটা গোলাপের চারা মরে গেলে, কি বাড়ির বেড়ালটা মরে গেলে সে কেঁদেছে। হয় তো লুকিয়ে। কিন্তু সে কেঁদেছে, কারণ তাকে সে মানুষের মত করেই পেয়েছে, তার মনুষ্যত্বের মায়ায়।
আমি তাই ওই মেয়েটার পাশেপাশে হাঁটার চেষ্টা করছি যখন সে মা হারানোর শোকে পুড়তে পুড়তে হাঁটছে, আমি বারবার থমকে থমকে যাচ্ছি। আমি পিছিয়ে পড়ছি, অনেকটা পিছিয়ে পড়ছি।
আর দ্বিতীয় পোস্ট নিয়ে বলার মত এগিয়ে তো নই। আমার ক্লাসে যদি আমার কোনো ছাত্রী বুকের বোতাম আলগা করে বসত, আমি সত্যিই বলছি মেনে নিতে পারতাম না। এ দোষ আমার শুধু না। আমার বড় হওয়ার। আমি দিদি, বোনের সাথে বড় হয়েছি। রাস্তাঘাটে বেরোবার আগে ওদের পোশাকের দিকে খেয়াল করেছি। কোনো ছেলে যদি বিশ্রীভাবে তাকায়? তাকিয়েছেও তো। অসহ্য লেগেছে। রাগ লেগেছে। কিছু করতে পারিনি। কি করব? মানুষের মধ্যে পশুত্বটাকে বাস্তব দুনিয়ায় অস্বীকার করি কি করে? আমি যখন বাড়ি থেকে বেরোই দরজায় তালা লাগিয়ে যাই। কারণ জানি মানুষের মধ্যে শুধুই দেবত্ব আশা করা খুব বড়মাপের আশাবাদী না হলে সম্ভব না। বিবেকানন্দ বলতেন, থানা পুলিশ না থাকলে ক'জন মানুষ ঠিক রাস্তায় থাকতেন, তা দেখবার।
আসলে ওই যে বললাম শিক্ষার দোষ। অথচ যখন সেই কালাহান্ডি গেছি, দেখেছি অর্ধনগ্ন পুরুষের পাশে স্বল্পমাত্র একটা শাড়ির প্যাঁচে বক্ষযুগলকে আবৃত করে কি সহজ ভঙ্গীতে কত নারীও ধান বুনছে। দেখতে চাইলে দেখাই যায় বিষনজরে। কিন্তু কি আশ্চর্য একটুও বেমানান লাগেনি। না তার কোনো অস্বস্তি, না আমার।
কিন্তু যতই যুক্তি দিই, পিছিয়ে যে পড়েছি এতো সত্যিই। আমার ক্লাসে একজন টুয়েলভের ছেলেও যদি অকারণে বুকের বোতাম খুলে বসেছে, আমার সেটা অসভ্যতা লেগেছে। বারণ করেছি। শুনেছে আমার চোদ্দ পুরুষের ভাগ্যি। হয় তো মফস্বলে থাকি বলে সে ছাড়টুকু পাচ্ছি। কিন্তু সে বা আমার কোনো ছাত্রী যদি এই নিয়ে তর্ক জুড়ত, বিশ্বাস করুন, হেরে যেতুম বলব না, তাদের বোঝাতে অপারগ হতুম। কারণ রুচি নিয়ে তর্ক চলে না।
বছর পনেরো আগের কথা। বাইশে শ্রাবণ, শিয়ালদহ থেকে বাড়ি ফিরছি। মনটা উদাস। শিয়ালদহ স্টেশানে সুচিত্রা মিত্রের গান বাজছে, “ওরে মাঝি, ওরে আমার মানবজন্ম তরীর মাঝি”... বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। আশেপাশের এত ছোটাছুটি হঠাৎ করে হারিয়ে গিয়ে কেমন পর্দা পড়ে গেল মনের চারপাশে।
ট্রেনে উঠলাম। প্রচন্ড ভিড়। বিকালবেলা। গুমোট গরম। দুটো সিটের মাঝের স্পেসে দাঁড়িয়ে আছি চ্যাপ্টা হয়ে কোনোরকমে। বুকে তবু বাইশে শ্রাবণের রবীন্দ্রনাথের বোজা চোখ, লক্ষ মানুষের মিছিল। ট্রেন ছাড়ল। হঠাৎ দেখি, এক তরুন তরুনী যুগল নিজেদের মধ্যে চুমু খাওয়া শুরু করল। ছেলেটা মেয়েটার গলা, চোখ, কপাল, ঠোঁট সব জায়গায় চুমু খাচ্ছে। আমি হতবাক হলাম। ক্রমশঃ বুঝতে পারছি প্রচণ্ড রাগের একটা ঊষ্ণতা তৈরি হচ্ছে সারা শরীরে। কান মাথা গরম হচ্ছে। নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছি। পারছি না। মনকে জিজ্ঞাসা করলাম, কেন রাগছি? আমিও কি মনের মধ্যে ওরকম কিছু একটা করার বাসনা রাখি, আর সেটা পারছি না বলে রেগে যাচ্ছি? নিজেকে কি কাপুরুষ বোধ হচ্ছে বলে এত রাগ? সত্যের একটা ধর্ম হল, সে সামনে এলে ধৈর্য আনে। এক্ষেত্রে আনল না। বুঝলাম ছেলেটারই একটা কথায়, যখন কিছু একটা বলতে গেলাম, সে বলল, অসুবিধা থাকলে চোখটা ফিরিয়ে নিন না।
সত্যিই তো তাই। অসুবিধাটা তো তাতে নয়, আমার রুচির। এ দোষ তো রবীন্দ্রনাথের, বিদ্যাসাগরের, সারদাদেবীর মত যাদের মনীষী বলি তাদের। এরকম একটা রুচি না তৈরি করলেই পারতেন?
আরেকটা ঘটনা। তখন আমি উচ্চ-মাধ্যমিক দিয়েছি, আমাদের রেল কলোনীটা ছিল ফাঁকা ফাঁকা। আমরা দু'তলায় থাকতুম। গরমের ছুটি, নীচের তলার কাকিমারা নেই। ফাঁকা। আমাদের কোয়াটার্সে ড্রেন পরিস্কার করতে আসত এক বিহারী বিধবা বৌদি আর তার দেওর। দুজনেই মধ্যবয়সী। ওরা ড্রেন টানার পর মাকে বলল, 'মা জী, আমরা নিচেটায় একটু বিশ্রাম নেব? খুব গরম।'
মা সম্মতি দিলেন। খানিক পরে মা আমায় বললেন, 'দেখত ওরা চলে গেছে কি না? গেলে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে আয়।' নীচে গিয়ে যা দেখলাম তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না, বৌদির অনাবৃত বক্ষে দেওরের হাত, আর বৌদির হাত দেওরের পুরুষাঙ্গে।
চমকে উঠে আসলাম। মাকে বললাম, পরে যাচ্ছি। এর বেশ কিছুদিন পর তারা মায়ের সামনেই এ অবস্থায় পড়ে যায় বলে মা তাদের কাজে বরখাস্ত করেন। কিন্তু এও তো তাদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ! জানি এর পক্ষেও তর্ক চলতে পারে।
তবু আমি পিছিয়ে। অনেকটাই পিছিয়ে। কবে তালা না লাগিয়ে বাড়ি থেকে বেরোবো আর কবে অনাবৃত সব কিছুকেই সংস্কৃত উদার মনস্কতায় দেখব, আশা করে আছি।