পশ্চিমবাংলায় গতকাল শিক্ষকদিবস হয়ে গেল। কোথাও দেখে কিছু বোঝা গেল না যে এই রাজ্যেই শিক্ষক সংক্রান্ত বেশ কিছু জ্বলন্ত সমস্যার ভিতর দিয়ে আমরা সবাই যাচ্ছি। এই নিয়ে যুক্তিও আছে।
১) প্রাইভেট স্কুল, দিল্লি বোর্ড, কেন্দ্রীয় বোর্ডের স্কুলে এর প্রভাব নেই।
২) পাড়ায় পাড়ায় কোচিং সেন্টার, সেখানেও এর কোনো প্রভাব নেই। বরং ওদিকে যত অবিশ্বাস, অনাস্থা, অপূর্ণতা এদিকে তত লাভ।
অগত্যা স্কুলে, কলেজে, কোচিং সেন্টারে 5th সেপ্টেম্বরের আগে পরে উৎসব তথা মোচ্ছব হয়ে গেল।
যদিও দুরাশা জানতাম, তবু মনে হয়েছিল, হয় তো অনেক শিক্ষক বা স্কুল এই বছরে অন্তত অনাড়ম্বরভাবে শিক্ষক দিবস পালন করবেন, বা করবেনই না। প্রতিবাদের একটা অংশ তো ত্যাগ স্বীকার অবশ্যই। এ দেশেই তো অন্যায়ের প্রতিবাদে অরন্ধন অবধি হয়েছে। তবে এই ক্ষেত্রে উৎসবের মেজাজ থেকে নিজেকে খানিক সরিয়েই বা রাখা যাবে না কেন?
অনেক যোগ্য শিক্ষক কোনোরকম দুর্নীতির সঙ্গে কোনোভাবে যুক্ত না থেকেও চাকরি হারিয়েছেন। এ সত্যি। তাদের ব্যক্তিগত জীবন, মানসিকতা, পারিবারিকভাবে জীবন, সামাজিক জীবন, ভবিষ্যতের একান্ত অনিশ্চয়তা তাদের কোথায় কোণঠাসা করে দিয়েছে সে আমরা অনুমানও করতে পারছি না। ইদানীং আইটি ক্ষেত্রে কর্মী ছাঁটাইয়ের হিড়িক শুরু হয়েছে। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি কী অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে এক একটা মানুষ যাচ্ছে। কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে প্রতিদিন মানুষ রাতে ঘুমাতে যেত আগামীকাল তার ভাগ্যে গ্যাস চেম্বারের ডাক আসবে কিনা এই আশঙ্কায়। আজ আইটির ক্ষেত্রে একই জিনিস ঘটছে। আর যে শিক্ষকদের সঙ্গে এটা ইতিমধ্যে ঘটে গেছে?
এর সবটাই উত্তর রাজনৈতিক না। সামাজিকও। আন্দোলন শুধু রাজনৈতিক স্বার্থে হলে সমাজের পক্ষে ভালো না। তার একটা মানবিক মুখ লাগে। দরদ লাগে। সহানুভূতি লাগে। চম্পারণে যেদিন মহাত্মা গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন সে ইংরেজ সরকারকে উৎখাত করবেন বলে না, একটা অমানবিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে বলে। সে উদ্দেশ্যর বিরদ্ধে রাজা থাকলেও সেটাই মুখ্য কারণ ছিল না। মুখ্য কারণ ছিল সহমর্মিতা। সমাজ থেকে রাজার নীতি জন্মায়। রাজা সমাজকে জন্ম দেয় না।
সহমর্মিতা কি রাজনৈতিক? সহমর্মিতা কি ক্ষুদ্র স্বার্থকেন্দ্রিক উদ্দেশ্যগামী? সহমর্মিতা কি সাত পাঁচ ভেবে নেওয়া অ্যাজেন্ডা মাত্র? নাকি সহমর্মিতা এমন একটা মানবিক আবেগ যা সুতোর মত ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানে থাকা মানুষকেও একটা সুতোয় বেঁধে রাখে? তার জন্য কি প্রবল ধীশক্তি লাগে? প্রবল বলশালী হওয়া লাগে? নাকি চিত্তের সেই অনাদি শুভ অনুজ্ঞার প্রতি সৎ হওয়া লাগে, যার নাম, অনুকম্পা। “আমি সহৃদয় পাশে আছি” বলার মনুষ্যত্বের গৌরব।
অনেকে বলবেন, আমি বড্ড বেশি আশা করছি। আমিও জানি করছি। কিন্তু আশাও না করব তো বাঁচব কী নিয়ে? শুধু যা আছে, সে-ই নিয়ে বেঁচে থাকে তো পশুরা। তাও পাখি নীড় বানায়, কেঁচো মাটি খুঁড়ে নিজের আস্তানা গড়ে। মানুষের সব চাইতে বড় আস্তানা তো তার আশা ভরসা। একের অভাব যদি অন্যকে পীড়া না দেয়, একের প্রতি অন্যায্য অসহায় আঘাত যদি অন্যকে না ভাবায়, উৎকণ্ঠায় ফেলে, তবে কীসের শিক্ষা?
সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণাণের লেখায় শিক্ষার মূল লক্ষ্য বিদ্যেবোঝাই বাবুমশাই হওয়া নয়, চরিত্র গঠন। আমার মধ্যে যদি একটা সামাজিক শরীর না থাকে তবে আমার আদতে অস্তিত্ব কতটুকু? রামচন্দ্র শুক্লা লিখছেন, ব্যক্তিগত জীবনে সত্যকে ধরে চলা যা নীতি, রাষ্ট্রে বা বৃহত্তর সমাজ জীবনে তাকেই ধরে চলা হল ধর্ম। মানব ধর্ম। সেই ধর্মে যদি উত্তরণ না ঘটে আমাদের, তবে যেই যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ, এ প্রবাদ বাক্যকেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম সত্য করে যাবে।
যারা আবার বসবেন পরীক্ষায়, যাদের আবার অগ্নিপরীক্ষা দিয়ে নিজেকে আবার প্রমাণ করতে হবে তাদের জন্য আমার আন্তরিক শুভকামনা জানাচ্ছি ভীষণ কষ্টের সঙ্গেই। নিজেকে প্রমাণ করে, দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করে আবার নিজেকে সেই একই কাজের জন্য প্রমাণ করতে হওয়ার মধ্যে যে গ্লানি, যে যন্ত্রণা, যে অপমান সে আমি কিছুটা হলেও হয় তো অনুমান করতে পারি। একটা দুঃসময় ভেবে সহ্য করে যাওয়া ছাড়া আপাতত আর কোনো উপায় নেই।
কিন্তু গতকাল অবধি যারা এই মোচ্ছবটা করলেন তারা একই সঙ্গে শুধু রাধাকৃষ্ণান না, বিদ্যাসাগর বলে যে ক্ষণজন্মা সোজা মেরুদণ্ড, দরদী ব্যতিক্রমী বাঙালি জন্মেছিলেন তাঁকেও অপমান করলেন। যে কাজটা আমার রুজিরোজগারের সঙ্গে জড়িত, সে কাজটার মর্যাদা যখন ক্ষুণ্ণ তখন সে কাজটাকে কেন্দ্র করে যে উৎসব তা উদযাপনের সময় সেটা নয়। উদযাপনকে ত্যাগ করাই তখন আরেকটা বড় ধর্মের উদযাপন - মানবিক সত্য ধর্মের।