যে কবিতাটা লেখা শুরু হয়েছিল দিনের মধ্যভাগে, সে কবিতার শেষ ছত্রের কয়েকটা শব্দ কবিকে এমন নাস্তানাবুদ করে ছাড়ল যে, ভাবতে ভাবতে সূর্য গেল পাটে। কবি অপেক্ষা করলেন, কখন জ্বলে উঠবে প্রদীপের শিখা। জ্বলে উঠল শিখা, কবি উত্তর দিকে বসলেন আসন পেতে, বাকি ছত্রের অপেক্ষায়।
যে মামলার কাগজগুলো নকল করতে হবে, সে কাগজগুলো বিকালের এলোমেলো হাওয়ায় গেল উড়ে এখানে সেখানে। খোঁজ খোঁজ খোঁজ। কোনো কাগজ গেছে বামুনপাড়ায়, কোনোটা মুচিপাড়ায়, কোনোটা সান্ধ্যসভায় প্রার্থনার মাঝে, কোনোটা হাটে মরা মাছের ভিজে আঁশে। সব কুড়িয়ে আনতে আনতে হল রাত, ততক্ষণে দীপ জ্বালা হয়েছে। মামলার কাগজ নিয়ে সে বসল প্রদীপের দক্ষিণ দিকে।
সকাল থেকে মানুষটা শাড়িগুলোর পাড় লাগাতে বসেছে। পাড়ের সাথে শাড়ির রঙ মেলে তো সুতোর রঙ মেলে না, সুতো মেলে তো সূঁচের ছিদ্রে প্রবেশ করাতে গিয়ে যায় ফেঁসোয় আটকিয়ে। ফেঁসো ছাড়াতে গিয়ে যেই না মুখে দেওয়া, অমনি নীল সুতোর গায়ে লাগে চিবানো পানের দাগ। এই করতে করতে গৃহস্থের ঘরে শাঁখ বাজল, সাঁঝের নৌকা ওঘাট থেকে ঘাস কেটে আনল, চাষীরাও বাড়ি ফিরল, কিন্তু তার সেলাইয়ের কাজ আর পুরো হল না। দীপ জ্বালা হয়েছে। সে সূঁচ সুতো কাপড়-চোপড় সব নিয়ে বসল প্রদীপের পশ্চিম দিকে।
এ সূত্রটা নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই, জানেন তিনি, কিন্তু বিবেকচূড়ামণি আর ব্রহ্মসূত্রের মধ্যে একটা মিল না পেলেই নয়। তিনি নিজেকে বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী প্রমাণ করতে চান। যদিও তাঁর গুরু তাঁকে অদ্বৈতবাদেই দীক্ষা দিয়েছেন, কিন্তু সে হলেও, রামানুজ আর শঙ্করাচার্যের মিল তিনি দেখিয়েই ক্ষান্ত হবেন। তিনি শ্লোকগুলো গুছাতে গুছাতে খেয়াল করেননি যে তাঁর উঠানের বটগাছটার ছায়াটা মস্ত হয়ে তাঁর ঘরের জানলা দিয়ে এসে ঘরখানাকে পুরো অন্ধকার করে ফেলেছে। যখন বুঝলেন, তখন বাইরে জোনাকি, মন্দিরে কীর্তন শুরু হয়েছে। কীর্তন তো দ্বৈতবাদের সাধন, সে পথটাও দেখা উচিৎ। ততক্ষণে দীপ জ্বলেছে। তিনি কয়েকটা শাস্ত্র নিয়ে দীপের পূর্ব দিকে বসলেন।
শিখা এই সময়ে নিজেকে ধন্য মনে করে। গর্বিত হয় সে। এই তো তার সার্থকতা। সে না হলে এতগুলো মানুষ অন্ধকারে কি করে!
মাটির প্রদীপের শরীর তখন শিখার তেজে তপ্ত। সলতে পুড়তে পুড়তে জ্বালানি বুকে প্রদীপের মাটির দেহকে বলল, ভালো থেকো, আমি আসি। ক্রমে ক্রমে সলতে নিঃশেষে শেষ করে ফেলল নিজেকে, জ্বালানিও। না জানল শিখা, না জানল মদমত্ত শিখাকে ঘিরে স্বার্থমগ্ন ওরা।
ভোর হল। যে যার ঘরে ফিরে গেছে। জ্বালানি আর সলতের শেষ অংশটুকু ভাঙা বাসরের কনের কাজলের মত শ্রীহীন হয়ে রয়েছে প্রদীপের গায়ে। প্রদীপের শরীর ক্লান্ত। তার অপেক্ষা একজনের।
সেই একজন এলো। নদীতে নিয়ে গেল তাকে। স্নান করালো। সাদা কাপড়ে মুছল তার গা। জিজ্ঞাসা করল, কেমন আছো?
প্রদীপ বলল, ভালো।
এখন তার শিখা নেই। সে আছে, যে তাকে ভালোবাসে, আলোর জন্য না, শুধুই তার জন্য। সে তাকে সাজাবে, তার গায়ে প্রসাদী চন্দনের চিহ্ন আঁকবে, সলতে আর জ্বালানিকে বুকে সাজিয়ে বলবে, ভালো থেকো, আমি আবার আসব, কাল।
আবার সত্যিই সে আসবে, আলোর জন্য না, শুধুই তার জন্য। কেউ জানবে না, কার জন্য জ্বলে শিখা, কার জন্য পোড়ে সলতে, জ্বালানি।
সৌরভ ভট্টাচার্য
19 November 2019