Skip to main content

বাঙালির থেকে থেকে বাঙালিত্ব নিয়ে গর্বের হাহাকার দেখলে আমার মাঝে মাঝে আজকাল ‘জলসাঘর’ সিনেমার ছবি বিশ্বাসের মুখটা মনে পড়ে। ছবিবাবু'র হৃত ক্ষমতা, প্রতিপত্তির উপর আসক্তির দীর্ঘশ্বাস ঘাড়ে এসে পড়ে। যে ভাষায় অর্থ থাকলে, ক্ষমতা থাকলে, সুযোগ থাকলে প্রাথমিক শিক্ষার কথা স্বপ্নেও ভাবা যায় না, যে ভাষায় নিজের শহরেই বহু জায়গায় কথা বলা যায় না, যে ভাষায় এমনকি চিত্তের বিনোদনের উপকরণের উপাদান অবধি সঙ্কুচিত হয়ে আসছে – সে ভাষা নিয়ে অবশিষ্ট শুধু গর্বের অধিকার। ইহা হাইস্যকর! বেশি দূর যেতে হবে না, আধুনিক বাঙালির দেখা শেষ কয়েকটা ওয়েব সিরিজ আর গানের উল্লেখ শুনলেই বোঝা যাবে কোন ভাষার দাপট বেশি।

      রবীন্দ্রনাথের ছবির বিষয়ে আসি। সত্যি বলতে এত যদি আলোচনা না হত তবে বহু আলোচিত ওই ছবিটায় যে রবীন্দ্রনাথের বা আমার চিত্তে রবীন্দ্রশ্রদ্ধায় কোনো আঘাত লেগেছে বলে আমার অন্তত মনে হত না। আজকে দেখলাম এক খবরের কাগজের প্রথম পাতায় এ খবর অবধি ছাপা হয়ে গেল।

      রবীন্দ্রনাথ পৌত্তলিকতার বিরোধী ছিলেন। সেই ওনার মূর্তিতে মালা দিয়ে যেদিন পঁচিশে বৈশাখের আয়োজন করেছি, সেদিনই আমরা প্রমাণ করেছি যে রবীন্দ্রনাথ কি শেখাতে চাইতেন, বিশ্বাস করতেন তার চাইতে বড় কথা আমি রবীন্দ্রনাথকে কিভাবে চাইছি। আমার চাওয়াটা যদি তাঁর শিক্ষার প্রতিকূলও হয়, আমার তবে আপত্তি নেই। রবীন্দ্রনাথ কি তীব্র আকুল আকাঙ্ক্ষায় মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা চাইতেন সে আলোচনা আর নাই বা করলাম। রবীন্দ্রনাথ নোবেল পেলেন যে বইটার জন্য বিশেষ করে, সে বইটার আকার লক্ষ্মীর পাঁচালির চাইতে বেশি বড় কিছু নয়। মোটামুটি অনেক বাঙালিই জানেন রবীন্দ্রনাথ কেন নোবেল পেয়েছিলেন, অন্তত আমার বিশ্বাস তাই, কিন্তু বাঙালি যে সুখে, যে আন্তরিকতায় বৃহস্পতিবার করে লক্ষ্মীর পাঁচালি পড়ে, বা যে সংখ্যক বাঙালির ঘরে লক্ষ্মীর পাঁচালি সযত্নে রাখা হয়, সে আদর রবীন্দ্রনাথের 'গীতাঞ্জলী' পেয়েছে বুঝি? ক'টা বাড়ি দেখেছেন?

      তবে হ্যাঁ, আমাদের তত্ত্বাবধানে একজন পৌত্তলিক রবীন্দ্রনাথ আমাদের মস্তিষ্কে গজিয়ে উঠেছে। যার নাকি থেকে থেকে অসম্মান হয়। যিনি নাকি থেকে থেকে অভিমান করে কোপাইয়ের ধারে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদেন। আমরা আবার তার অভিমান ভাঙিয়ে বলি, “আমরা বকে দিয়েছি দ্যাখো... অ্যাই কেন তুই আমাদের রবীন্দ্রনাথের ছবির উপরে ছবি ছাপিয়েছিস... হুম...!!! আপ!... এই দ্যাখো রবি ঠাকুর আমরা কেমন বকে দিলুম... আমরা তোমায় কত্ত ভালোবাসি না... উলি বাবালে... বাবা!”...

      যত্তসব ন্যাকা ভণ্ডের দল! রবীন্দ্রনাথ যেন আমাদের জমিদারির বংশানুক্রমে পাওয়া সোনার গোপাল। তাকে নাইয়ে, খাইয়ে, শুইয়ে, লোক দেখিয়ে আমাদের গর্বের প্রকাশ ঘটাতে হয়। তার মান রাখার কি সাংঘাতিক গুরুভার যেন আমাদের উপর। ওরে ভাই রে একটা দাড়িওয়ালা মুখ আঁকলেই রবীন্দ্রনাথকে আঁকা হয় না। কয়েকটা গান সুর তাল মেপে গাইলেই রবীন্দ্রনাথের সুরে জীবন বেজে ওঠে না। তাই যদি হত তাহলে মানুষটা শান্তিনিকেতনে অমন ধু ধু প্রান্তিক স্থানে সারাটা জীবন না কাটিয়ে প্যারিসে, আমেরিকায়, কি লণ্ডনে বাসা বেঁধে দিব্যি কাটিয়ে দিতে পারতেন গোটা জীবন। যেমন আজকালকার সেতার, সরোদ বাদক তথা ইংরাজিতে সাহিত্য লিখিয়ে বিশ্ববিখ্যাত মানুষেরা কাটিয়ে দেন। অনুগ্রহ করে মাঝে মাঝে দেশে ফেরেন, আর অভিমান করে বলেন -- এ দেশ আমায় নিল না, আমায় সুযোগ দিল না বিদ্যালয় খোলার, আমায় বুঝল না... আমায় নিল না... ইত্যাদি ইত্যাদি। এ মানুষটা তা বলেনি রে বাপ আমার! অনেক অভিমান করে চিঠিতে লিখেছিলেন বটে যে আর বাংলাতে জন্মানোর ইচ্ছাটা তাঁর নেই, আশা করি পরমেশ্বর তাঁর সে ইচ্ছা পূরণ করবেন। কিন্তু দোহাই আপনাদের, আর এই পৌত্তলিক রবীন্দ্রনাথের জন্য ক্ষণে ক্ষণে অপমানিত হবেন না। বর্তমান শাসকদলের নেত্রীকে নিয়েও এই এক অপমানের লীলা আগে দেখেছি – কেন সুভাষের পাশে, কেন রামকৃষ্ণের পাশে, কেন বিদ্যাসাগরের পাশে। আরে ভাই, ওই মানুষগুলোর শিক্ষা যদি সত্যি সত্যি আমাদের জীবনধারার সঙ্গে কিঞ্চিৎ মিশে যেত তবে আজকের দিনটা অবধি ঘটনা পৌঁছাতোই না। দেহের অনাক্রম্যতার ব্যবস্থা দুর্বল হলে রোগের প্রকোপ বাড়ে, সে রোগের উপর মান অভিমান করে থাকলে তা সারে কি?

      ঋষি অরবিন্দ, বিবেকানন্দ প্রমুখ পণ্ডিত মানুষেরা অবধি একটা শব্দের ইংরাজি করতে পারেননি, সেটা হল – শ্রদ্ধা। শ্রদ্ধা, অনুভবের বিষয়; মান, দেখানোর বিষয়। রবীন্দ্রনাথকে যা দিতে পারতাম তা হল নিখাদ শ্রদ্ধা। পারিনি। কিন্তু মান দেখানোর অনুষ্ঠান করে চলেছি বছর বছর ধরে। আর আমাদের সেই মান দেখানোর অনুষ্ঠানের রীতির সঙ্গে যদি কারোর রীতির বিভেদ ঘটল তবে হাঁ হাঁ করে ‘গেল গেল’ রব তুলছি। ভাইরে! আমরা ঘরের লোকেরা মানুষটাকে যত অপমানিত, ব্রাত্য, অপ্রাসঙ্গিক দিনে দিনে করে তুলেছি, সেখানে বাইরের কারোর কাছে আর কি-ই বা আশা করা যায়? ও ছবির অবস্থানে রবীন্দ্রনাথের কিছু যে আসে যায় না, কিন্তু তা এই পৌত্তলিক রবীন্দ্র আদেখলাপনায় তা বুঝব কি করে? বুঝব কি করে কোন ক্ষতিটা আসলে মুখ্য আর কোনটা গৌণ।

 

ছি ছি, চোখের জলে ভেজাস নে আর মাটি।

এবার কঠিন হয়ে থাক্‌-না ওরে, বক্ষোদুয়ার আঁটি।।

জোরে বক্ষোদুয়ার আঁটি ॥

পরানটাকে গলিয়ে ফেলে দিস নে, রে ভাই, পথে ঢেলে

মিথ্যে অকাজে--

ওরে নিয়ে তারে চলবি পারে কতই বাধা কাটি,

পথের কতই বাধা কাটি ॥

দেখলে ও তোর জলের ধারা ঘরে পরে হাসবে যারা

তারা চার দিকে--

তাদের দ্বারেই গিয়ে কান্না জুড়িস, যায় না কি বুক ফাটি,

লাজে যায় না কি বুক ফাটি?।

দিনের বেলা জগৎ-মাঝে সবাই যখন চলছে কাজে আপন গরবে--

তোরা পথের ধারে ব্যথা নিয়ে করিস ঘাঁটাঘাঁটি--

কেবল করিস ঘাঁটাঘাঁটি ॥