"আমাদের মধ্যে যাঁরা গম্ভীর প্রকৃতির, তাঁদের চিত্তবৃত্তি ধর্মানুরক্ত ; এবং অন্যেরা উপজীবিকার অন্বেষণে ব্যতিব্যস্ত। সুতরাং হয় চিরাচরিত অধ্যাত্ম চিন্তা, নয় অনায়াস আমোদ-প্রমোদ, এ ছাড়া অপর কিছুতে মেধার অপব্যয় আমাদের অনভিপ্রেত; এবং সেই জন্যে বাংলা দেশে যেমন মনীষীর সংখ্যা অগণ্য, তেমনই মননশীল সাহিত্যের - বিশেষত মননশীল কথাসাহিত্যের - অনটন অসম্ভব রকমের বেশি"
কথাটা সুধীন্দ্রনাথ দত্তের।
কথা হল আমি মননশীল লেখা পড়ব কেন? আমি যদি এখন মননশীল লেখা পড়তে বসি তবে দেখা যাবে আমার অনেক জ্ঞান-বিশ্বাসই আসলে ভুল, ফাঁপা, সঙ্কীর্ণ। মননের মাধ্যমে তাঁরাও যে একটা ঘন-স্থির সত্যকে জানাবেন তাও তো নয়, জাগাবেন কিছু সংশয়, আর জোগাবেন কিছু ভাবনা। কেন বাপু তবে ওসব পড়ে নিউরো ভাপে মস্তিষ্ককে জর্জরিত করা! তাই আমরা ওসব পড়িওনে, ভাবিওনে। তার চাইতে চোর-ডাকাত-ভূতপ্রেত-খুনোখুনি-নলেনগুড়ময় মিষ্টি ইতিহাসের মত লেখাতে সুখ অনেক বেশি। "গুরুগম্ভীর" লেখা তো গালিগালাজ তুল্য। ওসব "মাথার উপর দিয়ে যায়"। তার চাইতে বাপু রসেই ডোবো না কেন?
এখন আমার স্বভাবই হল বনের মোষ তাড়ানো শুধু নয়, মোষ গোনা, ঘরের নিয়ে গিয়ে বনের মোষকে খাওয়ানোও। আম না খেয়ে আম গাছের পাতাগোনাতেও আমার সুখ। স্বভাবের দোষ। আমার কিচ্ছুটি করার নেই।
এই যে আমি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়কে নিয়ে কদিন আগে লিখলাম। তারপর তার উপর তাঁর বাড়ির অবস্থা দেখে চক্ষুচড়কগাছ হল। কেন? আমায় তো বাপু এসবের জন্য কেউ পাঁচটা টাকাও দেয় না। এই যে লেখাপড়া, তথ্যাদি খোঁজার তাগিদ, কিসের জন্য? কিস্যুর জন্য না। পার্থিব লাভের চাইতে লোকসানই বেশি। কিন্তু ওই যে রক্তে একটা পরিচয় আছে, বাঙালি, তায় ভারতীয়, তায় বোধসম্পন্ন মানুষ। এই এক একটা পরিচয়ের এক একটা দায় আছে। সে দায়টাকে স্বীকার না করলে নিজের কাছে নিজে ছোটো হয়ে যেতে হয়। তাতে গণসাধারণের কিছু এসে না গেলেও কোথাও কিছু একটা যায়। আমার বিশ্বাস মুষ্টিমেয় হলেও আরো অনেকেরই নিশ্চয়ই যায়।
নৈহাটি বলতে মানুষের আগে মনে পড়ত বঙ্কিমচন্দ্র হয় তো বা। এখন বড়মা। "দেবতার জন্ম" এই বাংলা সাহিত্যেই লেখা হয়েছে। সেখানে মানুষের ঢল নামবে। সে স্বাভাবিক। আমাদের ধর্মপ্রাণ মন। কিন্তু সে ঢলের এক ক্ষুদ্রতম অংশও শাস্ত্রীজীর বাড়ি খুঁজবে না। কারণ আছে?
এক শাস্ত্রীজী অবতার, বা গুরু তেমন কেউ একজন নন। দুই, তিনি বিদেশী খেতাবও পাননি কিছু। তিনি বাঙালি যাতে বাঙলা ভাষাটা চর্চার মধ্যে রাখতে পারে, মননে, বিদ্যাচর্চায় সে চেষ্টা করেছেন। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের পরিচালনার সময়। আরও নানা কাজে।
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়কে নিয়ে আধুনিক প্রজন্ম চুম্বকে জানতে হলে রবীন্দ্রনাথের দুটো প্রবন্ধ, যা অনলাইনে পাওয়া যায় আর সাহিত্য একাদেমী থেকে বেরোনো ওনার জীবনীটা পড়ে দেখতে পারো, সত্যজিৎ চৌধুরীর লেখা, যথেষ্ট ভালো।
সেই মানুষটা এই বাড়িতে ছিলেন। কাজ করেছেন। কয়েকটা গাঁদাফুল আর একটা ফলকই কি যথেষ্ট তাঁর স্মৃতিবিজড়িত এই বাড়িটার? বলা হয় যাকে ভালোবাসি তার ছাতাটা, জুতোটাও ভালোবাসি। যদি বাংলা ভাষাটাকে ভালোবাসি তবে এই বাড়িটার উপর কি কোনো আবেগ নেই আমাদের? এর সংরক্ষণের জন্য কি কোনো ভাবনা ভাবব না?
আমার মনে হয় নিজের ভাষার উপর, সংস্কৃতির উপর ভালোবাসা, আবেগ থাকলে অবশ্যই তার ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা সবটুকুর প্রতি শ্রদ্ধা থাকবে। সে সব হেলায় ভাসিয়ে, শুধুমাত্র হুজুগে ভেসে কি লাভ? সময় সব নিয়ে যেতে চায়। যা রাখি, সে-ই আমায় রাখে। আমি যদি আমার ভাষা, সংস্কৃতিকে রাখি, তবে সেও আমাকে রাখবে, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রাখবে। এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
আবারও বলছি, আমি কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ সাহায্যপ্রাপ্ত গবেষক নই। আমার কোনো পার্থিব স্বার্থ এর সঙ্গে জড়িয়ে নেই। আমি যা বলছি সে শুধুমাত্র আমার অনুভব থেকে বলছি। যদি অপ্রাসঙ্গিক মনে হয় স্ক্রোল করে যেতে আর কতক্ষণ? ইতিহাস ভুললে পায়ের তলার মাটি সরে যায়, সেটুকুই যা বিপদ, এর বেশি আর কি?
(Debasish Bose অনেক ভালোবাসা এত যত্ন নিয়ে ছবিগুলো তুলে দেওয়ার জন্য)