Skip to main content

নিভাননী ও শশীবালা পাশাপাশি বসিয়া আছে। নিভার বয়েস হইয়াছে পঁচাশি। শশীর পঁচাত্তর। নিভার স্বামী রাজনৈতিক আন্দোলনে মারা যায়, বহু বছর আগে। শশীর স্বামী নিরুদ্দেশ, সেও বহু বছর হইল। নিভার স্বামী বলিত, ঈশ্বর নাই, ধর্ম আফিম সদৃশ। শশীর স্বামী ঈশ্বর খুঁজিতে গিয়া বিবাগী। দুই জায়ের মধ্যে নিভা পড়াশোনা জানে। ভালোই জানে। ইংরাজি, হিন্দি পড়িতে বুঝিতে পারে। শশী কিচ্ছুই জানে না। কিন্তু দুই জায়ে মিল ভীষণ। দুজনের দুই ছেলে, একজন ব্যাঙ্গালোরে, আরেকজন কলিকাতায় থাকে। দুজনের একটি করিয়া ছেলে আর মেয়ে। তাহারা কেহই বাংলা পড়িতে, লিখিতে পারে না। তবুও একবার নিভার নাতি মাতৃভাষা দিবসে, মাতৃভাষার উপর ইংরাজিতে প্রবন্ধ লিখিয়া নাম কুড়াইয়াছে। নিভা ইহা শুনিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়াছে। শশী বিহ্বল হইয়া ঠাকুরের নিকট নাতির আরো খ্যাতি বৃদ্ধির প্রার্থনা করিয়াছে।

শশী আজ সকাল হইতে উতলা। তাহার ইচ্ছা ছিল পরের বৎসর কাশী কিম্বা বৃন্দাবনে যাইয়া শেষ কদিন কাটাইবে। নিভাও রাজী হইয়াছিল। কিন্তু কদিন ধরিয়া অযোধ্যার কথা এত শুনিতেছে ও পড়িতেছে যে বুদ্ধি বেশ অস্থির হইয়া পড়িয়াছে। শশীর শিবে মতি। নিভার ঠাকুর রামকৃষ্ণে। রামের উপর ভক্তি আছে শশীর। কিন্তু সীতামাতাকে কেন ত্যাগ করিল, এই বলিয়া তাহার প্রাণে বড় বেঁধে। হয় তো স্বামী ত্যাগ করিয়াছে বলিয়াই। তাও তাহার গর্ভাবস্থায়।

শশী জিজ্ঞাসা করিল, হাঁ দিদি, আমরা মরিলে কি আর ‘'হরিবোল” বলিতে বলিতে লইয়া না যাইয়া, ওই ওদেশের মত “রামনাম সত্য হ্যায়” বলিবে? কি দিদি?”

নিভা বলিল, সে সেদিনের খবরের কাগজে যাহা লিখিবে তাহাই হইবে শশী। এত ভাবিও না। ভাবিবার লোক দেশে বাড়িয়াছে। কি করিতে হইবে এই লইয়া আমাদের আর না ভাবিলেও চলিবে।”

শশী উৎফুল্ল হইয়া বলিল, “এ বেশ ভালো হইল, না দিদি? উহারা কি গনৎ ঠাকুর দিদি?”

নিভা বলিল, “জানি না শশী। তবে উহারা গণঠাকুরের মন পাইয়াছে ইহা বিলক্ষণ জানি।”

শশী আরো খুশী হইয়া বলিল, সে কেমন ঠাকুর দিদি?” বলিয়াই কি ভাবিল। তারপর বলিল, আচ্ছা সে কথা থাক, এত কোটি দেবতা, আমি কজনকেই বা চিনি। তা দিদি বাইরেটা কেমন কালীপুজো কালীপুজো লাগিতেছে না? কিন্তু এত হিন্দি গান কেন দিদি? রামের বাংলা গান নাই?”

নিভা বলিল, “রামের বাংলা গান জানিস তুই?”

শশী বলিল, “বাবা হয় তো জানিত।”

শশী ছোটো বয়সে বাবাকে হারায়। কাকার সংসারে প্রায় অনাহারে মানুষ। তাই পড়াশোনাটা হইয়া ওঠেনি। নিজের সব অসম্পূর্ণতা বাবার মধ্যে কল্পনা করিয়া লয়। তাহার বাবার স্বভাব লোকে বলিত সদাশিব মানুষ। হয় তো সেই কারণেই শিবের উপর শশীর এমন আস্থা।

পাশের বাড়ির গোবর্ধন চ্যাটুজ্যে গানের শিক্ষক। রবীন্দ্রসংগীত, আধুনিকগান, ভক্তিমূলক সঙ্গীত শেখাইয়া থাকেন। তিনি সন্ধ্যে হইতেই “হরে রাম, হরে রাম” করিয়া নৃত্য করিতেছেন বাড়ির উঠানে।

শশী নিভাকে বলিল, আচ্ছা দিদি, গোবরদার তো পাঁঠার ঝোল না খাইলে রবিবার হয় না, মাঝে মাঝেই “জয় তারা” বলিয়া চীৎকার করিয়া ওঠেন। তিনি হঠাৎ এমন “রাম রাম” করিয়া নাচিতেছেন। পাঁঠা ছাড়িলেন কিনা জিজ্ঞাসা করিব কি? আমাদের তো ভারী খোঁটা দেন, বিধবা হইয়া মাছ খাই বলিয়া। যাই দিদি?”

নিভা বলিল, “কি দরকার শশী। ওঁর স্ত্রী মরিয়াছে এক যুগ হইল, উনি কি একদিনও মাছ ছাড়া কিছু মুখে তুলিয়াছেন….. ওসব ছাড় ভাই….”

নিভা আর শশী চুপচাপ বসিয়া আছে। শশীর মন অস্থির। নিভাকে বলিল, দিদি একটা রামের মন্ত্র বলো না গো…..

নিভা বলিল, “যাঁহার মুখারবিন্দ রাজ্যাভিষেকের সময় প্রফুল্ল হয় নাই, ও বনবাসে ম্লান হয় নাই, তিনি আমাকে আনন্দ দান করুন”। তুলসীদাস লিখিয়াছেন, অযোধ্যাকাণ্ডে।

শশী হাসিয়া বলিল, তবে তো আমি বৃন্দাবনে মরিলে উনি রাগ করিবেন না, না দিদিভাই?

নিভা হাসিয়া বলিল, “মনে তো হয় না।”

শশী বলিল, “আর মাছ, মাঝে মাঝে পাঁঠার ঝোল খাইলে?”

নিভা বলিল, “জানি না শশী। তবে বাঙালির ঘরে যখন জন্মাইয়াছিস, ওইটুকু ক্ষমাঘেন্না উনি করেই নেবেন। বাঙালির মত পরমুখাপেক্ষী আর ক'টা জাত আছে বল দেখি। শুধু নিজের মুখটাই চিনতে পারিল না। চল ভাই ওঠ….. সনাতনের মায়ের জ্বর…. দেখিয়া আসি গিয়ে…. নইলে স্বামীর সঙ্গে সেও সতী হইবে…. বরটা তো যা মাতাল……"

শশী আর নিভা দরজায় তালা লাগাইয়া গলির মধ্যে দিয়া চলিয়াছে। পথে কালীমন্দির পড়িল। শশী গড় হইয়া প্রণাম করিয়া বলিল, "মা, তুই নিরামিষাশী হইলে আমিও হইব। জানাইয়া হোস মা। গোপনে নহে।"