পাঁচু পাগলা জেটিতে এসে বসেছে। গ্রামে সবাই তাকে এই নামেই ডাকে। লঞ্চ আসতে দেরি আছে আরো আধঘন্টা। হঠাৎ খুব জোরে আওয়াজ শুনে ফিরে তাকালো, একটা লরি করে অনেক লোক এসেছে। বড় বড় বক্স বাজছে। হিন্দী গান হচ্ছে। কি ড্রাম পেটানো আওয়াজ। বেশি লোক দেখলে পাঁচু পাগল জড়সড় হয়ে যায়। এখনও হল। তার পিঠের ব্যাগটা পিঠ থেকে খুলে বুকের কাছে নিয়ে নিজেকে শামুকের মত গুটিয়ে বসল।
লরি থেকে হুড়মুড় করে সব নামল। দেখতে দেখতে জেটি ভরে গেল। পাঁচু পাগলা একটা কোণে এসে বসল। ওদের সঙ্গে দুটো বড় বড় বস্তা। ওরাও ত্রাণ দিতে যাচ্ছে। সঙ্গে পনেরোজন। সুন্দরবন পাঁচুর বড় হওয়ার জায়গা। ক্যানিং-এই তার দোকান। সাইকেল সারানোর দোকান। একটা বড় সাইকেলের দোকান দেওয়ার ইচ্ছা ছিল অল্প বয়সে, এখন আর নেই। পাঁচুর আসলেই কোনো অভিযোগ নেই। দুয়ে দুয়ে চার করতে যে পারে তার অভিযোগ থাকে না, যে পাঁচ কি দশ করতে চায় তারই যত অভিযোগ।
ওরা ছবি তুলছে। নিজেদের, জলের। পাঁচুর ছবিও কেউ কেউ তুলল মনে হল। পাঁচু মুখটা ঘুরিয়ে নিল জলের দিকে। তার ব্যাগে চারটে বিস্কুটের প্যাকেট, দুই প্লাস্টিক চাল, গম আর এক প্লাস্টিক আটা। তেমন কিছু নয়। তবু মানুষের কষ্টে মানুষের পাশে দাঁড়াতেই তো হয়। এটা বুদ্ধির কথা না। এটা বুকের কথা। বুদ্ধি মাথায় থাকে, বুকের মধ্যে থাকে দীঘি। দীঘির জলে মানুষের দুঃখের ছায়া পড়ে। সে দেখতে বুদ্ধি লাগে না, লাগে মন। বুদ্ধিমান মানুষ স্বার্থপর হয়, নয় হিসাব রেখে দেয়-থোয়। মানুষের কান্না না বুঝে তার চোখের জল মুছাতে যাওয়া তো তাকে উপহাস করা। সে পাপ।
পাঁচু দেখল আরো কিছু লোক এলো। না এরা তো লোক না, এনারা সন্ন্যাসী। মানুষের জন্য এসেছেন। মানুষকে ভালোবাসলে এনারা ভগবানকে কাছে পান। খুব বড় কথা এটা। বোঝেনা, শুনেছে। পাঁচু যদিও ভগবানকে এড়িয়ে চলে।
তার দোকানের সামনে আগে খুব জল জমত। সবাই বলল, তুমি হরিপদ নেতাকে জানাও না, সে সব ঠিক করে দেবে। এতো পাইপ ফাটা জল। পাইপ সারালেই জল কমবে।
পাঁচু একদিন গেল। সন্ধ্যেবেলা। হরিপদ নেতার বাড়ি কে না চেনে। বাড়ির সামনে অত বাইক, সাইকেল আর চটির ভিড় আর কার হয়? পাঁচু জড়সড় হয়ে ঢুকল। এত এত লোক, কত কত কথা, কত সমস্যা সবার। পাঁচুর লজ্জা লাগল কিছু বলতে। সে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলো। তার আসাও কেউ খেয়াল করল না, যাওয়াও না। পাঁচু স্বস্তি পেল।
ফেরার সময় ভাবল কালীবাড়ি হয়ে আসবে। ভগবান যদি কিছু করেন। কিন্তু সেখানেও যা ভিড়! পাঁচু আবার লজ্জা পেল। এই কারণেই সে ভগবানের কাছে যায় না। বড় ব্যস্ত তিনি। ওঁকে ব্যতিব্যস্ত করতেও পাঁচুর লজ্জা লাগে। তাছাড়া প্রায়ই সে শোনে এই ধর্মের মানুষ ওই ধর্মের লোকেদের মেরেছে, পাঁচুর মনটা খারাপ হয়ে যায়। একদল মানুষের ভগবান আরেক দল মানুষের কাছে শয়তান হয়ে যায় কি করে? পাঁচু বোঝে না।
পাঁচু দেখল সন্ন্যাসীদের সঙ্গে অনেক সামগ্রী। তার কত সামান্য।
লঞ্চ চলে এলো। সবাই হুড়মুড় করে উঠতে লাগল। পাঁচুও উঠল। একটু ঠেলাঠেলি কম হওয়ার পর।
লঞ্চ চলছে। সবাই গল্প করছে। লরির বক্স বাজানো লোকেরা গল্প করছে রাজনীতির, খেলার, সিনেমার, ছবিতোলার, অন্য ক্লাবের। আর সন্ন্যাসীরা গল্প করছেন শাস্ত্রের, ঈশ্বরের নানারকম ইচ্ছার, ভাগ্যের, জ্যোতিষের। পাঁচু লঞ্চের যন্ত্রের আওয়াজ শুনছে। জল কেটে কেটে লঞ্চ চলার আওয়াজ শুনছে।
লঞ্চ থামল। সবাই নামল। এবার ত্রাণ বিলির পালা। লঞ্চের একদল লোক গ্রামের দিকে চলে গেল। আরেক দল লোক একটা ফাঁকা মাঠের দিকে গিয়ে বক্স বসালো। ওখানে পিকনিক হবে। এ আগেও দেখেছে পাঁচু। ভালো লাগে পাঁচুর। মানুষ এত উল্লাসপ্রিয় হয়! পাঁচুর মত নাকি সবাই? গরীব, বোকা, ভাবুক। ওরা বাস্তববাদী। পাঁচু বাস্তব মানে বোঝে না। মানুষ মানে বোঝে। মানুষ কি বাস্তব? না। মানুষ প্রদীপের শিখার মত। এই আছে, এই নেই। হাওয়ায় নিভে যায়, জলে নিভে যায়, কেউ জোর করে ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দেয়। মানুষ কি বাস্তব?
সন্ন্যাসীরা পতাকা লাগিয়ে, বড় কাপড় লাগিয়ে তৈরি। কাপড়ে ওদের গুরুদেবের ছবি। সব গুরুরা ঈশ্বরের কাছের মানুষ। পাঁচুর ইচ্ছা হয় সেও গুরুর কাছে যায়, দীক্ষা নেয়। কিন্তু ভয় করে। তার বুকের মধ্যে যে দীঘি, যে দীঘিতে উড়ে যাওয়া সাদা বক, শঙ্খচিলের ছায়া পড়ে, সে দীঘি শুকিয়ে গুরু যদি অন্য জল ভরে? সে অনেককে দেখেছে, গুরুর কাছে যাওয়ার পর দীঘির জল শুকিয়ে হয় কেঠো মানুষ, না হয় পাঁকে ভরা মানুষ হয়েছে। থাক, তার হৃদয়দীঘিতে জল থাকলেই হবে। ঈশ্বর ব্যস্ত। তিনি স্পষ্ট না থাকলেও হবে। আর ঈশ্বরের না থাকাও থাকা। এটা স্পষ্ট না হলেও, আবছা বোঝে পাঁচু। লালনের গানে।
পাঁচু আলপথ দিয়ে হাঁটছে। ঘন্টা খানেক হাঁটলে একটা গ্রাম। সেখানেই পাঁচু যাবে। ওটা তার মায়ের গ্রাম। মা জন্মেছিল সেখানে। সেই গ্রামের সবাই যেন তার আত্মীয়। আত্মীয়বোধ না হলে মানুষের পাশে দাঁড়াতে লজ্জা করে পাঁচুর। মনে হয় তাদের যেন সে উপহাস করছে। মানুষকে উপহাস করা পাপ।
পাঁচু প্রত্যেক সপ্তাহে বৃহস্পতিবার আসে। আজও যাচ্ছে। তার মাথার উপর ভাসছে সাদা মেঘ, বক আর কয়েকটা ফড়িং উড়ছে আনমনে। সবাই পাঁচুর আত্মীয়। পাঁচুর বুকের মধ্যে দীঘির জল দুলে দুলে উঠছে। আনন্দে। আসতে পারার আনন্দে। কিছু আনতে পারার আনন্দে। সে দোলা জলে আবার মেঘের ছায়াও আছে। মানুষের এত দুঃখ, এত অসহায়ত্ব আর তার থেকেও বড় এত নানারকম অপমান - সেই সব না বলতে পারা কষ্টে জমা মেঘ। দুই আছে। মানুষ ভীষণ অবাস্তব যে!