ঈশ্বর বড় একা। সারাটা আকাশ গেরুয়া রঙ করে বসেছিলেন সূর্যাস্তের পর গঙ্গায় পা ডুবিয়ে। বাতাস পঞ্চপ্রদীপের শিখার মত ঈশ্বরকে ঘুরে ঘুরে আরতি করছিল। ঈশ্বর গম্ভীর। গঙ্গার জলের কুলকুল শব্দে ঘন্টার আওয়াজ। ঈশ্বর অন্যমনস্ক।
একটা পালতোলা নৌকা দক্ষিণ থেকে উত্তরের দিকে আসছে। লাল রঙের পাল ফুলে উঠেছে অভিমানীর মত। তার পিছনে পিছনে আসছে ছোট্টো একটা ডিঙি। ঈশ্বর তাকালেন উদ্দেশ্যহীন। ছেঁড়া ফাঁকের ভিতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে চাঁদ। সদ্য উঠল। আর উঠেছে একটা সন্ধ্যাতারা। ঈশ্বরের মনে নেই কারা কবে সৃষ্টি হয়েছিল। তারা যেন তারই মত সময়ের আবর্তহীন, পরিধিশূন্য কেন্দ্রবিন্দু।
জেলে জাল ফেলল। তার বয়েস নিরানব্বই। তার গলায় কণ্ঠী, কণ্ঠে ঈশ্বরের নাম। তার জাল গিয়ে আটকালো ঈশ্বরের পায়ে। কয়েকটা লাল, নীল, কমলা, সবুজ মাছ ঈশ্বরের আঙুলগুলোর সাথে খেলছিল। তারা আটকে গেল জালে। তার ক্ষুদ্র পাখার উদ্বিগ্নতা ছটফটানিতে ছোটো ছোটো বুদবুদ উঠলে জলের উপরে। ততক্ষণে চাঁদ উঠেছে অনেকখানি। তার ছায়া, বুদবুদের আন্দোলনে চঞ্চল হয়ে উঠল।
ঈশ্বর মাছগুলোকে জালের বাঁধন মুক্ত করলেন। তারা বন্দনা করে মিলিয়ে গেল জলের নীচের ছোটো ছোটো গর্তে। তার হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন এখনও দুরুদুরু। জলের উপরিতল হল স্থির। চাঁদের ছায়া হল পূর্ণ অখণ্ড। জেলে টান দিল জালে। ঈশ্বরের পায়ে লাগল টান। তিনি শূন্য হয়ে হলেন একটা সদ্য প্রস্ফুটিত শালুক। জেলে জাল তুলে অবাক - গঙ্গার জলে শালুক! শালুকের গন্ধটা যেন চন্দনের। জেলে সে শালুক নিয়ে রাখলেন বিছানায়, মাথার বালিশের পাশে। তার ঘরে বিগ্রহ নেই। পূজার উপকরণ নেই। তার আছে গান আর গলার কণ্ঠী।
ঘুমের মধ্যে জেলের ঘরের পাশে বাজল নূপুর। জেলে ঘুম থেকে উঠে বাইরে এসে দেখে তার ঘরের চারপাশে ফুটেছে শালুক। প্রতিটা শালুকের মাথায় একটা করে চাঁদ। দূরে কে বসে? জেলের চোখে ছানি। কাছে গিয়ে ঘ্রাণে বুঝল তার স্ত্রী। চোদ্দো বছর তার শূন্যশয্যা, স্বপ্নসঙ্গ শুধু। জেলে স্ত্রী'র কোলে মাথা দিয়ে শুলো। চোখ বুজল কথাদের ঘুম পাড়িয়ে। কে যেন বাঁশি বাজাচ্ছে গঙ্গার তীর থেকে। চাঁদ অস্তমিত প্রায়। শুকতারা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে জেলের প্রশান্ত মুদিত চোখের দিকে।
ভোরে জেলের প্রাণহীন দেহ পাওয়া গেল আমবাগানে। তার জালের মধ্যে একশো আটটা শালুক। সেদিন শুকতারা জেগে রইল কয়েক প্রহর বেশি। সবাই আশ্চর্য হল - জেলের সারা গায়ে চন্দনের সুবাস।