বামুনদের বাগানে কাকভোরে যখন নাপিতদের নধর ছাগলটা ঢুকলো, কেউ খেয়াল করেনি। প্রমাদ গুনেছিল লতাগাছটা, যে কয়েক মাস হল আমগাছটাকে জড়িয়ে সদ্য ডালপালা ছড়িয়ে সুখের মুখ দেখেছিল।
যা ভয় তাই হল। গোটা লতাগাছটাকে মুড়িয়ে খেলো ছাগলটা। লতাগাছটা পুবাকাশে উঠতে থাকা সূর্যকে করুণ সুরে বলল, এভাবেই যদি নেবে, তবে প্রাণ দিয়েছিলে কেন?... আমগাছকে বলল, আমায় ভুলো না।
ছাগলটার শেষরক্ষা হল না। লতাগাছটা খাওয়ার পর, বামুনদের বাগানের আরো কয়েকটা শখের ফুলগাছ মুড়িয়ে খাওয়ার পর যখন সে বেরোতে যাচ্ছিল, বিষনজরে পড়ল বামুনের, যে দাঁতন করছিল কুয়াপাড়ে।
নাপিত এসে হাতেপায়ে ধরল। নাপিতের বউ বামুনের বাড়ি কাজ করে। নাপিতও নাপিতের কাজ ছাড়া আরো ফাইফরমাশ খাটে বামুনের। কাজ গেল দু'জনেরই।
কিন্তু রাগ তো রাগই। অন্য যুগ হলে তো ব্রহ্মশাপে এতক্ষণে ব্যাঙ কি আরশোলা হয়ে যেত নাপিত আর তার বাঁজা বউ!! এমন সব কড়া কড়া কথা শুনিয়ে, তাদের তাড়িয়ে, সেই ছাগলের তরকারি খেয়েও, কিসের একটা খটকা থেকে গেল বামুনের।
ওদিকে আমগাছটাও ভুলতে পারছে না লতাগাছটাকে। সে লতার পাতাবাহারের জন্য না। না তো লতার নীলফুলের জন্য। লতা যেন তার কি একটা নিয়ে গেল। নিজেকে কেমন কম মূল্যবান, কম গুরুত্বপূর্ণ লাগে। সূর্য উঠলে একটা সঙ্কোচ হয়, যেন সে আর সবার মত সাধারণ। হাওয়া দিলে মনে হয় তাকে ব্যঙ্গ করছে সবাই। ঠাট্টা করছে তার সাধারণত্বের সামান্যতা নিয়ে।
বামুনেরও কিছু ভালো লাগে না। আগে রাস্তায় বেরোলে গরীব মানুষগুলোর অসহায়, সম্মান দেওয়া, সম্ভ্রম দেওয়া চোখগুলো দেখলে আত্মায় একটা তুষ্টি জন্মাতো। তাদের দারিদ্র্যর উপর করুণা করার সুখ পেত। এখন লজ্জা লাগে! একটা কাজের লোক নেই, একটা ফাইফরমাশ খাটার লোক নেই। এভাবে চলে!
বামুন এসে আমগাছের নীচে বসে। দু'জনের দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয়ে ওঠে বাগানের হাওয়া।
একদিন ভোরে আমগাছ খেয়াল করল তার মাটির কাছে গুঁড়িতে কার যেন কোমল স্পর্শ। আরে! এ যে শীর্ণ লতা একটা!
লতা বলল, আমার মা ছিলেন আপনাকে জড়িয়ে। আপনি মহান। আপনি আশ্রয় দিয়েছিলেন।
আমগাছের পাতাগুলো উঠল উজ্জ্বল হয়ে। বলল, বটেই তো…বটেই তো। এসো এসো। আমার উদারতা, আমার করুণা আশ্রয় করে বাঁচো। এসো।
ওদিকে বামুনের বাড়ি নাপিত এলো ক্ষমা চাইতে। ছাগলের শোক সে ভুলেছে। পেটের দায় মানের দায় থেকে অনেক বাস্তব।
বামুন বললেন, আরে এসো এসো। ক্ষমাই মহতের ধর্ম। আমি মহৎ। জানোই তো। সারা গাঁ জানে। আর তুমি তো সামান্য নাপিত! আমার মহত্বে, আমার উদারতা আশ্রয় করে বাঁচো।
বড় করে উৎসবের আয়োজন হল বামুনের বাড়ি। লক্ষ্মীঘটে সেজে এলো আমের পল্লব।