সন্ধ্যাবেলায় একটা নৈর্ব্যক্তিক শুষ্কতা ঘিরে থাকে। হাস্পাতালের বাইরে পুকুরটার দিকে তাকিয়ে আমার সারাদিনের হিসাব। পুকুরের জলের রঙ এত বদলে বদলে যায় আগে জানতাম কই? এখন জানি। আমি তো ছবি আঁকতে জানি না, জানলে আঁকতাম। আমাদের পাশের বাড়ির বাচ্চাটা ছবি আঁকা শিখতে যেত। প্রথম প্রথম আমার অবাক লাগত, ছবি আঁকা আবার কেউ শেখে নাকি? আমি যেখানে বড় হলাম সেখানে ওসব কই ছিল? আমি জানতাম যে আঁকতে জানে, সে এমনিই বরাবর আঁকতে জানে। যে জানে না, সে কোনোদিনই জানে না। যেমন আমি।
আমার মৃত্যুর অনেকক্ষণ পরও আমি বুঝতে পারিনি আমি মারা গেছি। ওরা যখন আমার মুখটা সাদা চাদরে ঢেকে একটা ট্রলিতে শুইয়ে চলে গেল, আমি তখনও জানি না। আমি ট্রলিটা ঠেলতে গিয়ে বুঝলাম, আমি কি হাল্কা হয়ে গেছি! আমার সারা শরীর জুড়ে যত কালশিটে, যত ফোলা দাগ সব স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অতীত এখন। আমি আছি। এই তো আমি আছি।
আমি ভাবতে পারি। আমি ভাবনাগুলো শব্দে লিখে রাখতে পারি। ওই যে লিখলাম না, ‘নৈর্ব্যক্তিক’, এই শব্দটার মানে আমার গুরুদেব আমায় শিখিয়েছিলেন। মানে আমি নেই, আবার আছিও। নিজের থাকাটাকে ‘না’-এর মত করে ফেলতে হয়। নিজেকে আর হতে দিতে নেই। রাগ, ক্ষোভ, যন্ত্রণা, মনে মনে অভিশাপ দেওয়া - এগুলো বারবার হওয়া। নিজেকে হতে দিতে নেই। আমি দিই না, আর। এখন অবশ্য সব ফুরিয়ে গেল। ওরা সময় করে সব পোড়াতে নিয়ে যাবে। আমায় না, আমার অতীতকে। আমি এখন এই পুকুরের ধারটায় একটু বসি। দূরে ট্রেন লাইন। শব্দ আসে হালকা। ট্রেন যাচ্ছে। কারা যেন চলে যাচ্ছে। যাক, আমার কোথাও যাওয়ার নেই। আমার জন্যে কারোর ডাকও নেই। এই ভালো।
আমি পুরুষ না নারী? বুঝে গেছ তো? নারী। এখন ওসব কিছু না। এখন প্রেতাত্মা। আমার নামের আগে এই কথাটা বলে পুরুত মন্ত্র পড়বে। আমি যাব না। আমি আর ফিরব না। আমার এখন শুধু বসে থাকার সময়। খিদে, তেষ্টা, ঘুম - কিছুই তো নেই। আমি যদি বসে থাকি তবে কিসের আপত্তি? কার আপত্তি?
কি প্রশ্ন করছ? ভগবানকে দেখেছি নাকি? ভগবান নেই। এটা বেঁচে থাকতে থাকতেই বুঝে যায় সবাই। মানতে পারে না। একটা সুখের বিশ্বাস - ছাড়তে পারে না। তবে আত্মা আছে। আমি মরার আগেই জানতাম। ঘুমের মধ্যেই টের পেতাম, আমি আছি। ঘুমের মধ্যেও জেগে আছি। স্বপ্ন দেখছি। স্বপ্ন বাছা যায় না, তবে স্বপ্নের মোড় ফিরিয়ে দেওয়া যায়। আমি সে খেলা অনেকবার খেলেছি। স্বপ্ন মোড় ফিরিয়ে ফিরিয়ে। তারপর জেগে উঠে এমন ভাব করেছি যেন ওসব স্বপ্ন মিথ্যা ছিল। কারুর স্বপ্ন মিথ্যা হয় না। স্বপ্নের মধ্যেও শয়তানী করা যায়। আমি করেছি।
আমি কোনো কিছুর আকার দেখতে পাচ্ছি না আর। জড়বস্তুর আকার দেখছি, কিন্তু জীবন্ত কোনো শরীরের আকার দেখছি না কেন? এরকম হয় আমি জানতাম না। আচ্ছা বেঁচে থাকতে যে আকারগুলো দেখতাম, সেগুলো সত্যি? ধুস্... সব ঢপ। যাকে যেমন দেখতে সেকি আসলে তেমন? কাউকেই কি সত্যি সত্যি দেখতে পাই আমরা? সব আবছা দেখি। এখন বরং কাউকে দেখছি না, কিন্তু একটা অনুভব হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমার পাশ দিয়ে যে গেল সে ভালো। সে ক্ষতি করতে চায় না। সে বোকা। কিম্বা হয় তো আরো বড় কোনো ক্ষতির মতলবে ঘুরছে।
এবার উঠব। কি বলছি, বসলাম কখন যে উঠব? আমার ওঠা-বসা-শোয়া আছে নাকি? কিচ্ছু নেই। আমি এখন শুধু নিজের জীবনের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবব, আবার যদি জন্মাবার ঘটনা ঘটে, আমি কি চাইব জন্মাতে আবার? নাকি চাইব না? আচ্ছা আপনার জীবনে এমন কোনো ঘটনা আছে যার জন্য আপনি আবার জন্মাতে চাইবেন? আমার নেই। আমার নেই বলেই আমার মধ্যে কোনো চাপ সৃষ্টি হচ্ছে না। একটা চাপ সৃষ্টি হলেই মানুষ জন্মায়।
আমি মারা গেলাম, এও আমার ইচ্ছাতেই। আমি চাইলে আরেকটু শ্বাস নিতে পারতাম। নিলাম না। কেন বলব? আমি ওই মেয়েটাকে খুঁজতে এসেছি? যে মেয়েটার চুল ছিঁড়ে, কামড়ে হিঁচড়ে, গলার নলি কেটে খুন করল না কে একটা? তাকে নাকি আগে ধর্ষণও করা হয়েছিল। সে মেয়েটা কোন ক্লাসে পড়ত মনে আছে আপনার? থ্রি-তে না কিসে যেন? সে যাক, তার রক্তাক্ত দেহ নাকি সিঁড়ির উপর দুমড়ে পড়েছিল। এরপরও মানুষে মন্দিরে যায় না? হা হা হা... এরপরও মানুষে বিশ্বাস করে কেউ যেন আছে, ওই আকাশের উপর? কে আছে গো শয়তান, ঈশ্বর, না কালা-বোবা-খোঁড়া কোনো হাওয়া? হুস্...!
আমি মেয়েটার সঙ্গে দেখা হলে এইটাই বলব সেই সময় লোকটার চোখ কেমন ছিল? আমি তো দেখতে পাইনি। তখন মাঠে অন্ধকার ছিল না? প্রচণ্ড অন্ধকার তো। শীতের কনকনে বাতাস। তার মধ্যে অতগুলো মানুষ। এমনি পুরোটা পুড়িনি বলে আমায় যখন হাস্পাতালে নিয়ে এসেছে, আমি তাও জানি না। আমি তখন অচেতনে আমার স্বপ্নগুলোর মোড় ফেরাচ্ছিলাম। লোকে বলে আমার মাথায় ক্যান্সার। যারই মাথায় গোলমাল তার মাথাতেই নাকি ক্যান্সার। সে যাক, আমি ওই বাচ্চা মেয়েটাকে এইটাই শুধু জিজ্ঞাসা করতাম, ও যখন ওরকম করছিল তখন চোখদুটো কেমন দেখাচ্ছিল? আমার মানুষের মধ্যে বাস করা পশুর চোখদুটো দেখার একবার খুব ইচ্ছা। ঈশ্বরের পাথুরে চোখ মন্দিরে দেখে দেখে মন পচে গেছে। আর বাচ্চাটা যদি ছবি আঁকতে পারে কি দারুণ হবে বলুন, ও আমায় এঁকে দেখিয়ে দেবে। যদি আঁকতে পারে, আমি আপনাদের দেখানোর জন্য ওকে দিয়ে প্রতিটা স্কুল, বাড়ি, মন্দিরের দেওয়ালে দেওয়ালে আঁকিয়ে দেব। যদি মিল পান। যদি কাউকে কাউকে বাঁচাতে পারেন, দেখুন। আমি চেষ্টাটা করি আগে। ঠিক আছে? আপনারা যা করছিলেন করুন, আমি এটুকু বলব বলেই ডেকেছিলাম। আসি, ভালো থাকবেন।