একজনের জীবনী লেখার জন্য সে মানুষটাকে যতটা কাছ থেকে দেখতে হয় ততটা কাছ থেকে দেখা আমার হয়ে ওঠেনি। এমনও নয় যে তিনি একজন সেলিব্রিটি যে গাঁয়েগঞ্জে সবাই তাকে চেনে। অথবা এত তথ্য চারদিকে ভেসে বেড়াচ্ছে যে হাত বাড়ালেই পাওয়া যাবে। তবু সে জীবনের নিজস্ব একটা আলো ছিল। ধার করা আলো নয়, তবে তো আর লেখার তাগিদই সহ্য করতে হত না। বরং যেটুকু জানি সেটুকু বলার চেষ্টা করি।
ধরে নিই গ্রামের নাম করবী। ধরে নিই মেয়েটার নাম সীতা। আমাদের বাল্মীকি'র লেখা সীতার সাথে কোনো মিল নেই। তবু সেই নামই থাক। রবীন্দ্রনাথ বলেন, দুঃখ তপস্যা। আমার মনে হয় প্রতিটা মহাকাব্যের মধ্যেই সেই মাটির জীবনের মূলসুরটা খুব সার্থকভাবে আঁকা থাকে। আমাদের রামায়ণ, মহাভারতে দেখো কেমন ত্যাগের কথাটা, কর্তব্যের কথাটা বড়ো করে দেখানো হয়েছে। না, বড়ো করে না, প্রধান করে দেখানো হয়েছে। তবে বনে গেলেই কি আর ত্যাগ হয় বলো? যে ত্যাগে মানুষ নিজের ক্ষুদ্রতার বাইরে না যেতে পারল সে ত্যাগে কি লাভ বলো? নইলে বনে তো কত জন্তু-জানোয়ার, রাক্ষস, সাধুরাও থাকে। তাদের নিয়ে তো মহাকাব্য দুটো লেখা হল না। লেখা হল দুই রাজ পরিবার নিয়ে। তাদের ঘিরে কত সাধু-মহাত্মা, স্বয়ং বিধাতা পর্যন্ত ভগবান নাম ধরে হাজির হল গো! সত্যিই কোনো দেশের মহাকাব্যের নির্যাসটুকু পান না করে সেই দেশের সাহিত্য চর্চা করতে যাওয়া আর নেট অফ্ করে জিপিএস অন্ করা একই বস্তু কি বলো? আচ্ছা আমাদের ছোটোবেলায় রামায়ণ, মহাভারতের গপ্পো দোকতা পানের গন্ধে ম ম করতে করতে কে শুনিয়েছে বলো তো? হুম... ঠাকুমা দিদিমারা। আর ঠাকুর্দা দাদুরা? ধুর, পুরুষ মানুষেরা আবার ভিতের কাজ কবে করল, তারা তো ছাদে উঠে ভাবের ঘুড়ি ওড়াতেই ব্যস্ত, মানে ওই জগত উদ্ধার আর কি। সংসারে যত তুচ্ছ, সাধারণ, অগৌরবের কাজের জন্য রইল তো ওরা, যারা ঘোমটার আড়াল থেকে সব সামলিয়ে পুরুষের কৃপাদৃষ্টির অপেক্ষায় বিনিদ্র রজনী কাটাবে! যাক সে কথা, তা সংসার তো আর তুমি আমি বানাইনি বলো, যা বনে গেছে তার মধ্যে এসে পড়েছি এই যা, যেতে বললেই চলে যেতে হবে। তবু দু-চার কথা শোনানোও তো চাই, তাই আর কি।
তো সেই দিদিমা-ঠাকুমারা আর নেই জানো। প্রোডাকশান বন্ধ প্রায়। অ্যাম্বাসাডারও উঠল, দিদিমা ঠাকুমারাও গেল গেল করছে, মানে সেই রামায়ণ-মহাভারতের দিদিমা ঠাকুমারা। এক সিরিয়াল রাক্ষসে সব সারলে।
মেয়েটার সাথে তার ঠাকুমার খুব বনতো। পান সেজে, বড়ি দিয়ে, কাঁথা সেলাই করে, রান্না শিখে, ক'টা দিন পাঠশালায় গিয়ে চলেই যাচ্ছিল। সেই উঠানেই রাম-রাবণের যুদ্ধ হত, তাদের বারান্দাতেই দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ হল, তাদের বাড়ির পিছনের জঙ্গলেই রাম সীতা আর লক্ষণকে নিয়ে বনবাসে গেল। তাদের চালে বসা, আমগাছে হুলুস্থুলু করা হনুমানের দলই শ্রীলঙ্কায় গেছিল। শ্রীলঙ্কা বেশি দূর না তাদের বাড়ি থেকে, ওই তো সামনের বড় দীঘিটা পেরোলেই, ওপারে যে বড় রাস্তা গেছে, বড় বড় বাস যায়, ওরা সব লঙ্কায় যাচ্ছে।
হঠাৎ তাদের বাড়িতে খবর এলো তাকে নাকি দেখতে আসছে। দেখতে আসা মানে কি রে ঠাকুমা? দেখতে আসা মানে তুই অযোধ্যা যাবি। সীতা যেমন গিয়েছিল তেমন। মেয়েটা কি বুঝল জানি না। তার ঠাকুমা তাকে গেলবার পয়লা বৈশাখে একটা নতুন ছোট্টো পিতলের কলসী কিনে দিয়েছিল। সে সেটাকে কাঁখে নেওয়া অভ্যাস করল, বা রে, তাকে তো তার মায়ের মত সংসার করতে হবে নাকি? তবে? সে ঠাকুমার সাথে কোমর দুলিয়ে জল আনতে যেত। ঠাকুমার সাথে বিয়ের পরের গল্পগুলো ঝালিয়ে নিত, মানে সীতার যা যা করতে হয়েছিল আর কি। কতগুলো শাশুড়ি ছিল সীতার। ঠাকুমা অবশ্য বলেছে তার একটাই শাশুড়ি হবে, আর তার দেওর নেই, শ্বশুরও নেই।
মেয়েটার শরীরে যৌবন আসার আগেই সিঁথিতে সিঁদুর এসে গেল। রান্নাঘর পেয়ে গেল। স্বামী মানে অনেক কিছু বুঝে গেল। স্বামী মানে - কিছুটা সুখ, কিছুটা ভয়, কিছুটা মন খারাপ, আর বাকি কিছুটা কি সে সেদিন বোঝেনি আজ বোঝে – একটা টকমিষ্টি আমের মত ভালোবাসা। স্বামীর ব্যবসা। বিরাট ব্যবসা। এত বড়োলোকের সাথে তাদের বিয়ে হয় না, কিন্তু তার রূপের জন্যেই নাকি এতকিছু সে পেল। সীতা যখন বাষট্টি বছর বয়সে মৃত্যুশয্যায়, তার এই কথাগুলো মনে হচ্ছিল। তাকে ধরে ধরে যখন usg ঘরে নিয়ে যাচ্ছিল, এক ঝলক সীতা নিজেকে আয়নায় দেখেছিল, অনেকদিন পর দেখেছিল, পেটটা জলে ফোলা, মুখটাও, কিন্তু মুখটা তার তবু সুন্দর।
সীতা বাংলাদেশে থাকে না এখন। সে থাকে নৈহাটিতে। তার এখন তিনটে মেয়ে। তার স্বামীর ব্যবসা আরো রমরম করছে। তবে কানাঘুষো একটা কথা কানে আসে যে তার স্বামীর অফিসে কে যেন একটা প্রায়ই আসে। তার স্বামীর সাথে ভাব। সেও নাকি কম রূপসী নয়। কিন্তু সে কথা ভাবার সময় কোথায় সীতার এখন? জীবন মানে তো শুধু ভোগ নয়। সে যা পেয়েছে তাই বা কম কি? এটা ঠিক তার স্বামীর মনের বাতাস এখন অন্যদিকে। বোঝে সে। স্বামীর জন্য ভাত বাড়ে, জামাকাপড় কাচে, হেসে কথা বলে, যদি সোহাগ চায় তো তাও দেয়। কিন্তু জানে মনের সুরটা বদলে গেছে। মেয়েমানুষের মন বাতাসের উল্টোদিকের গন্ধও বুঝতে পারে। তাছাড়া বাচ্চাদের জন্য সারাদিনের নানা কাজের রুটিন তো আছেই। সীতা দীক্ষা নিল। তার নিজের মনের বাতাসও ঘোরাতে হবে যে!
আজ মৃত্যুশয্যায় সীতা এসব কিছু ভাবে না। বছর দেড়েক হল সে বিছানা নিয়েছে। সামনে তার ইষ্টদেবের ছবি ঝোলানো দেওয়ালে। তার স্বামীর উপস্থিতির শূন্যতা সে এই বিশ্বাসেই কাটিয়েছে যে সে অনাথ নয়। সংসারের ভালোবাসার শূন্যতা ঈশ্বরবিশ্বাস ভরিয়ে দেয়। সবটা নয়, তবে কিছুটা তো বটেই। সীতা চাল বাড়ন্ত দেখেনি কোনোদিন, বলেছে যথেষ্ট আছে, দু'জন অতিথিরও হয়ে যাবে এমন আছে। জানে সেটা মিথ্যা কথা। প্রাণপণ ডেকেছে, ঠাকুর কেউ যেন না আসে। ভাগ্যের জোরেই বলো, ঈশ্বরই দয়াতেই বলো – কেউ আসেনি এটা সত্যি।
তার সংসার আলাদা হল। মানে দুই শাখা হল। এক ভরা শ্রাবণের রাত্রে তার স্বামী এসে বলল সে বিয়ে করেছে, আলাদা সংসার পেতেছে, তার দ্বিতীয় স্ত্রী আসন্নপ্রসবা। একটা না, এতগুলো নির্মম কথা লোকটা উচ্চারণ করে গেল দেওয়ালে ঝোলানো তাদের বিয়ের ছবিটার দিকে তাকিয়েই। সীতার মনে হল তার শ্বাসরুদ্ধ করে মেরে ফেলছে যেন কেউ। তার ছোটো মেয়েটা কেঁদে উঠল। কাঁথা পাল্টাতে গেল। মনে মনে প্রার্থনা করল যেন এই ফাঁকে তার স্বামী চলে যায়। এসে দেখল সে খাটে উঠে বসে আছে। তার দিকে পিছন ফিরে। তার টাকার কোনোদিন কোনো অসুবিধা হবে না বলে সে চলে গেল। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে না ধরে গেছে বুঝতে পারছে না সীতা। তবে ধরেইছে মনে হয়, নইলে ও বেরোবেই বা কেন।
সীতা একবারই গিয়েছিল তার সতীনের বাড়ি। মেয়েটার মুখটা দেখে তার করুণাই হয়েছিল। রাক্ষসী নয়, বাংলার ঘরে ঘরে জন্মায় আগাছার মত কত মেয়েমানুষ, এও তাদের একজন। চোখদুটোতে অপরাধ আর কৃতজ্ঞতা মিশিয়ে সে যেন ভিক্ষা চাওয়ার মত তার দিকে তাকিয়েছিল। তাকে প্রণামও করেছিল।
সীতা আর কোনোদিন যায়নি। সে ক্রমশ নিজেকে সাম্রাজ্ঞী করে নিয়েছে তার ছোটো সংসারে নিজেকে। হাজার ব্যস্ততা তার। মনের মধ্যে একটা তুমুল ঝড় উঠে শান্ত হল। কতদিনে হল সীতার অন্তর্যামীই জানেন। ওই যে তপস্যা বললাম, সীতা সেই তপস্যায় মগ্ন হল। তার সব চাইতে বড় তপস্যা নিজের মান রক্ষার। সীতা জানে ভিক্ষা করলে দানপাত্র উপচালেও মানের পাত্র শূন্য হয়। সীতার দিকে আঙুল তোলা, তাকে করুণা জানানোর কোনো অবকাশ সীতা কাউকে দিল না। অথচ কত কাছেই তার স্বামীর দ্বিতীয় সংসার। দুটো সংসারের মধ্যে বৈরিতা কোনোদিন জন্মালো না, থাকল একটা দূরত্ব। লোকে কুৎসা রটাবার, গল্প বানাবার কোনো রসদই পেলো না। ক্রমে ভুলেই গেল এরকম একটা ঘটনা তাদের জীবনযাপনের সমান্তরালে ঘটে চলেছে।
সীতার এখন শ্বাস নিতে অসুবিধা হয়। পাশেই অক্সিজেন সিলিণ্ডার রাখা থাকে। তার মেয়ে জামাইরা দেখাশোনা করে যায় এসে যে যার মত। সীতা এখন শুধু দেখে। তার সামনে শরতের আকাশের মেঘের মত সব ঘটনাগুলো বয়ে যায়, তাদের আকার আকৃতি আছে কিন্তু আঘাত দেওয়ার মত ক্ষমতা নেই। তার মেয়েদের সে শিখিয়েছে, পুরুষের মত সংসারে থাকিস। বরের টাকা বরেরই জানবি, বড়জোর সংসারের, কিন্তু নিজের জন্য যা করে হোক কিছু জমাবি। সেই তোর দুর্দিনের সঞ্চয় জানবি।
দুর্দিন যখন এসেছে তখন দুটো পরিবারেই একসাথে এসেছে। অলক্ষ্যে সামাল দিয়েছে সীতা – সবার বড়ো মা। ধীরে ধীরে পরিবারের, পাড়ার সবার বড়ো মা হয়ে উঠল সীতা। সব ক্ষোভ, সব না পাওয়া ভগবান পুষিয়ে দিয়েছেন তার, দিয়ে না, না পাওয়ার ক্ষোভ সহ্য করার ক্ষমতা দিয়ে। ক্ষোভের বিকার সংসারে সে কম দেখেনি, লজ্জা লেগেছে তার। তাই নিজের মানহানি হতে দেয়নি সীতা একদিনের জন্যেও। এই কি কম! তাকে সমীহ করে চলে সবাই। এমনকি তার স্বামীও। তার পায়ের কাছে বসে যখন সে তার পা টেপে তখন তার বিয়ের প্রথম দিনগুলো মনে পড়ে। খাটটা তো একই। চাদরটাই বদলিয়েছে শুধু সময়ের সাথে সাথে, খাটের কাঠ আর জাজিমটা বদলালো কই?
সীতার শরীরের অবস্থা ভালো না। সীতা জানে। তার মাঝে মাঝে মনে হয় সে যেন তাদের গ্রামের বাড়ির উঠানে বসে আছে ঠাকুমার সাথে। সে বলে, ও ঠাকুমা চল্, এই দেখ কলসী নিয়েছি, চল্ জল ভরে আনি গে। তার আরো কত কথা মনে পড়ে যায়। হাসি পায়। একবার দইয়ের বাটিতে আরশোলা দেখে তার ঠাকুমা ভেবেছিল বুঝি তেঁতুল, হাতে তুলে চেটেও ফেলেছিল... সীতা খিলখিল করে হেসে ওঠে... কলসী চায়... সবাই বোঝে সীতা আর থাকবে না। সীতা কারোর কান্নার আওয়াজ পায় না আর। অথচ এই সংসারে অদেখা চোখের জল, অশ্রুত কান্নার শব্দ শুনতে পেতো সীতাই – সবার বড়ো মা।
বৃহস্পতিবার। লক্ষ্মীপূজোর কাঁসর ঘন্টা বাজছে চারদিকে। সীতার শ্বাস উঠল। খবর গেল এ বাড়ি ও বাড়ি। কেউ এলো গঙ্গাজল নিয়ে, কেউ কন্ঠে কৃষ্ণনাম। হাতের থেকে সদ্য মাজা বাসনের ঝুড়ি গড়িয়ে পড়ল ওবাড়ির দ্বিতীয়পক্ষের স্ত্রী'র। সে যে এতদিনে সীতার বোন। এতবড় প্রাণ সে না কোনোদিন দেখেছে, না শুনেছে। সংসারে কোনো অমঙ্গলে কেউ যদি বলেছে, দেখো গে হয়ত তোমার বড় সতীন তুকতাক করেছে। অমনি নাকের পাটা ফুলে উঠেছে ছোটো'র, ঘাড় শক্ত হয়েছে, ঝাঁঝাঁলো গলায় বলে উঠেছে, ও কথা বলবেন না, আমার মা-বাবাও কোনোদিন আমার নামে হয়ত বা তুকতাক করলেও করতে পারে, দিদির নামে এতবড় অপবাদ আমি সইব না। বলতে বলতে কান্নায় গলা বুজে এসেছে। কোথাও সে নিজেও তো অপরাধী।
সেই ছোটো আজ যখন হবিষ্যি করতে বসল, তার বারবার মনে আসতে লাগল তার দিদিকে দেখা প্রথমবারের মুখ, যেন দেবী প্রতিমা। তার হবিষ্যির দলার সাথে চোখের জলের নোনতা স্বাদ মিশে যেতে লাগল বারবার, তার মায়ের বেলাতেও এত কান্না সে কাঁদেনি।
এই জীবনের কোনো উপসংহার হয় না। একটা অপূরণীয় অভাব আর একটা অনস্বীকার্য গন্ধ রেখে যায় চিরকাল। সব মৃত্যু তো একরকম নয় না, তাই কিছু কিছু মৃত্যু অনেকের জীবনে আলোকবর্তিকা হয়ে জ্বলে থাকে। অত্যন্ত দুর্দিনে ঈশ্বরের ছবির কাঁচেও যেদিন নিজের ছবিই আসে, কোনো অলৌকিক সাড়া আসে না, সেদিন এই চরিত্রগুলো সামনে এসে দাঁড়ায়। বাংলার বুকে আটপৌরে ঘরে এমন মেয়েমানুষও জন্মায়!